পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । শব্দতত্ত্ব ዓ@6: কাল করিয়াছে- অতএব এই আকারই লুপ্ত যফলার ঐতিহাসিক চিহ্ন। ইহারা পূর্ব ইতিহাসেরও চিহ্ন, এখনকার ইতিহাসেরও চিহ্ন | মাছ শব্দের উত্তর বাংলাপ্রত্যয় উয়া যোগ হইয়া মাছুয়া হয়, মাছুয়া শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যবহার ‘মেছো ; মেছো শব্দের উত্তর স্ত্রীলিঙ্গে নি প্ৰত্যয় হইয়াছে। এই নি প্রত্যয়ের হ্রস্ব ই প্রাচীন দীর্ঘ ঈকারের ঐতিহাসিক অবশেষ। আমরা যদি বাংলার অনুরোধে মৎস্যকে কাটিয়া কুটিয়া মাছ করিয়া লইতে পারি এবং তাহাতে যদি ইতিহাসের জাতি নষ্ট না হইয়া থাকে, তবে বাংলা উচ্চারণের সত্যরক্ষা করিতে দীর্ঘ ঈ-র স্থলে হ্রস্ব ই বসাইলেও ইতিহাসের ব্যাঘাত হইবে না । মুখে যাহাই করি, লেখাতেই যদি প্রাচীন ইতিহাস রক্ষা করা বিধি হয়, তবে ‘মৎস্য লিখিয়া “মাছ পড়িলে ক্ষতি নাই। পণ্ডিত বলিবেন, আমরা সংস্কৃত শব্দেও তিন স, দুইন, যা ও হ্রস্ব-দীর্ঘস্বরকে লিখি শুদ্ধ, কিন্তু পড়ি অশুদ্ধ, অতএব ঠিক সেই পরিমাণ উচ্চারণের সহিত বানানের অনৈক্য বাংলাতেও চালানো যাইতে পারে । তাহার উত্তর এই যে, অনেক বাঙালি ইংরাজি w বর্ণের উচ্চারণ করেন নার্তাহারা লেখেন wood, কিন্তু উচ্চারণ করেন oিod; কিন্তু তাই বলিয়া নিজের উচ্চারণদোষের অনুরূপ বানান করিবার অধিকার তাহার নাই ; ইহা তাহার নিজস্ব নহে ; ইহার বানানে হস্তক্ষেপ করিলে অর্থবোধই হইবে না । কিন্তু, আলমারি শব্দ ‘আলমাইরা’ হইতে উৎপন্ন হইলেও, উহা জন্মান্তরগ্রহণকালে বাঙালি হইয়া গেছে ; সুতরাং বাংলা আলমারি-কে 'আলমাইরা” লিখিলে চলিবে না । সহস্র পারসি কথা বিকৃত হইয়া বাংলা হইয়া গেছে, এখন তাহাদের আর জাতে তোলা চলে না ; আমরা লোকসান-কে 'নুকসান লিখিলে ভুল হইবে, এমন-কি, লুকসান-ও লিখিতে পারি না। কিন্তু যে পারসি শব্দ বাংলা হইয়া যায় নাই, অথচ আমাদের রসনার অভ্যাসবশত যাহার উচ্চারণের কিছু ব্যতিক্রম হয়, তাহার বানান বিশুদ্ধ আদর্শের অনুরূপ লেখা উচিত। অনেক হিন্দুস্থানি নাইয়ের নীচে ধুতি পরে ; আমরা তাহাদের প্রথা জানি, সুতরাং আশ্চর্য হই না- কিন্তু সে যদি নাইয়ের নীচে প্যান্টলুন পরে, তবে তাহাকে বন্ধুভাবে নিষেধ করিয়া দিতে হয়। নিজের জিনিস নিজের নিয়মেই ব্যবহার করিতে হয়, পরের জিনিসে নিজের নিয়ম খাটাইতে গেলেই গােল বাধিয়া যায়। যে-সংস্কৃতশব্দ বাংলা হইয়া যায় নাই, তাহা সংস্কৃতেই আছে, যাহা বাংলা হইয়া গেছে, তাহা বাংলাই হইয়াছে- এই সহজ কথাটা মনে রাখা শক্ত নহে । u কিন্তু কেতাবের বাংলায় প্রতিদিন ইহার ব্যতিক্রম হইতেছে। আমরা জড়-এর জ এবং যখন-এর য একই রকম উচ্চারণ করি, আলাদা রকম লিখি । উপায় নাই। শিশু বাংলাগদ্যের ধাত্রী ছিলেন যাহারা, তাহারা এই কাণ্ড করিয়া রাখিয়াছেন । সাবেক কালে যখন শব্দটাকে বর্গ জ দিয়া লেখা চলিতফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতরা সংস্কৃতের যৎ শব্দের অনুরোধে বর্গ জ-কে অন্তস্থ যা করিয়া লাইলেন, অথচ ক্ষণ শব্দের মূর্ধন্য ণ-কে বাংলায় দন্ত্য ন-ই রাখিয়া দিলেন। তাহাতে, এই যখন শব্দটা একাঙ্গীভূত হরগীেরীর মতো হইল ; তাহার ኳg আধভালে শুদ্ধ অন্তস্থ সাজে p আধভালে বঙ্গ বগীয় রাজে । সৌভাগ্যক্রমে আধুনিক পণ্ডিতরা খাটি বাংলাশব্দকে অবজ্ঞা করিয়া তাহাদের রচনাপঙক্তির মধ্যে পারতপক্ষে স্থান দেন নাই- কেবল যে-সকল ক্রিয়া ও অব্যয় পদ নহিলে নয়, সেইগুলাকে সংস্কৃত বানানের দ্বারা যথাসাধ্য শোধন করিয়া লইয়া। তবে তাঁহাদের লেখার মধ্যে প্রবেশ করিতে দিয়াছেন। এইজন্য অধিকাংশ খাস বাংলা কথা সম্বন্ধে এখনো আমাদের অভ্যাস খারাপ হয় নাই ; সেগুলার খাটি বাংলা বানান চালাইবার সময় এখনো আছে । ... আমরা এ কথা বলিয়া থাকি, সংস্কৃত ব্যাকরণে যাহাকে ণিজন্ত বলে, বাংলায় তাহাকে ণিজন্তু বলা যায় না। ইহাতে যিনি, সংস্কৃত ব্যাকরণের অপমান বোধ করেন, তিনি বলেন, কেন ণিজন্তু বলিব না, গাহে নাকি কেহ সুস্বরবিহনে। ]