পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । শব্দতত্ত্ব ዓ (ሱ ዒ খাটি বাংলা কথাগুলির নিয়ম অত্যন্ত পাকা- উট কথাটাকে কোনোমতেই স্ত্রীলিঙ্গে ‘উটী করা যাইবে না, অথবা দাগ শব্দের উত্তর কোনোমতেই ইত প্রত্যয় করিয়া ‘দাগিত হইবে না,ইহাতে সংস্কৃত ব্যাকরণ যতই চক্ষু রক্তবর্ণীকরুন। কিন্তু সংস্কৃতশব্দের বেলায় আমাদের স্বাধীনতা অনেকটা বেশি। আমরা ইচ্ছা করিলে “এই মেয়েটি বড়ো সুন্দরী বলিতে পারি, আবার “এই মেয়েটি বড়ো সুন্দর ইহাও বলা চলে। আমাদের পণ্ডিতমশায় এক জায়গায় লিখিয়াছেন, “বিদ্যা যশোর হেতুরূপে প্ৰতীয়মান হয়।” প্রতীয়মান কথাটা তিনি বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু যদি সংস্কৃতনিয়মে “প্ৰতীয়মান” লিখিতেন তাহাও চলিত । আর-এক জায়গায় লিখিয়াছেন, “বিভীষিকাময়ী ছায়াটাকে বঙ্গভাষার অধিকার হইতে নিষ্কাশিত করিয়া দিতে পারেন— ছায়া শব্দের এক বিশেষণ ‘বিভীষিকাময়ী’’ সংস্কৃত বিধানে হইল, অন্য বিশেষণ “নিষ্কাশিত’ বাংলানিয়মেই হইল। ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, সংস্কৃতশব্দ বাংলাভাষায় সুবিধামত কখনো নিজের নিয়মে চলে, কখনো বাংলানিয়মে চলে। কিন্তু খাটি বাংলা কথার সে-স্বাধীনতা নাই— “কথাটা উপযুক্ত হইয়াছে এমন প্রয়োগ চলিতেও পারে, কিন্তু “কথাটা ঠিক হইয়াছে' না বলিয়া যদি “ঠিক হইয়াছে বলি, তবে তাহা সহ্য করা অন্যায় হইবে । অতএব বাংলারচনায় সংস্কৃতশব্দ কোথায় বাংলানিয়মে, কোথায় সংস্কৃতনিয়মে চলিবে তাহা ব্যাকরণকার বাধিয়া দিবেন না, তাহা অলংকারশাস্ত্রের আলোচ্য। কিন্তু বাংলাশব্দ ভাষার ভূষণ নহে, ভাষার অঙ্গ— সুতরাং তাঁহাকে বোপদেবের সূত্রে মোচড় দিলে চলিবে না, তাহাতে সমস্ত ভাষার গায়ে ব্যথা লাগিবে ; এইজন্যই, ‘ভ্ৰাতৃবধু একাকী আছেন অথবা ‘একাকিনী আছেন দু-ই বলিতে পারিকিন্তু ‘আমার ভাজ একলা আছেন না বলিয়া “একলানী আছেন এমন প্রয়োগ প্রাণান্ত সংকটে পড়িলেও করা যায় না। অতএব, বাংলাভাষায় সংস্কৃতশব্দ কিরূপ নিয়মে ব্যবহার করা যাইবে, তাহা লইয়া পণ্ডিতে পণ্ডিতে যত ইচ্ছা লড়াই করুন, বাংলা-বৈয়াকরণের সে-যুদ্ধে রক্তপাত করিবার অবকাশ নাই । আমার প্রবন্ধে আমি ইংরেজি monosyllabicঅর্থে ‘একমাত্রিক কথা ব্যবহার করিয়াছিলাম, এবং “দেখ, মারা প্রভৃতি ধাতুকে একমাত্ৰিক বলিয়াছিলাম, ইহাতে প্রতিবাদী মহাশয় অত্যন্ত রাগ করিয়াছেন । তিনি বলেন ; * ব্যাকরণশাস্ত্রানুসারে হ্রস্বস্বরের একমাত্রাব্দীর্ঘস্বরের দুইমাত্রা, প্লুতম্বরের তিনমাত্রা ও ব্যঞ্জনবর্ণের অর্ধমাত্রা গণনা করা হয় । অতএব তাহার মতে দেখ ধাতু আড়াইমাত্রিক । এই যুক্তি অনুসারে ‘একমাত্রিক শব্দটাকে তিনি বিদেশী বলিয়া গণ্য করেন । ইহাকেই বলে বিসমােল্লায় গলদ । মাত্রা ইংরেজিই কী বাংলাই কী আর সংস্কৃতই কী। যদিচ প্রাচীন ভারতবর্ষ আধুনিক ভারতের চেয়ে অনেক বিষয়ে অনেক বড়ো ছিল, তবু ‘এক তখনো ‘একই ছিল এবং দুই ছিল ‘দুই' । পণ্ডিতমশায় যদি যথেষ্ট পরিমাণে ভাবিয়া দেখেন, তবে হয়তো বুঝিতে পরিবেন, গণিতশাস্ত্রের এক ইংলন্ডেও এক, বাংলাদেশেও এক এবং ভীষ্ম-দ্ৰোণ ভীমাৰ্জনের নিকটও তাহা একই ছিল। তবে আমরা যেখানে এক ব্যবহার করি অন্যত্র সেখানে দুই ব্যবহার করিতে পারে। যেমন, আমরা এক হাতে খাই, ইংরেজ দুই হাতে খায়, লঙ্কেশ্বর রাবণ হয়তো দশ হাতে খাইতেন ; আমরা কেবল আমাদেরই খাওয়ার নিয়মকে স্মরণ করিয়া ঐ-সকল ‘বাহুহাস্তিক খাওয়াকে “ঐকহাস্তিক বলিয়া বৰ্ণনা করিতে পারি না। সংস্কৃত ভাষায় যে-শব্দ আড়াইমাত্রা কাল ধরিয়া উচ্চারিত হইত, বাংলায় সেটা যদি একমাত্রা কাল লইয়া উচ্চারিত হয় তবুও তাঁহাকে আড়াইমাত্ৰিক বলিবই-সংস্কৃত ব্যাকরণের খাতিরে বুদ্ধির প্রতি এতটা জুলুম সহ্য হয় না। পণ্ডিতমহাশয়কে যদি নামত পড়িতে হয়, তবে সাতসত্তে উনপঞ্চাশ কথাটা তিনি কতক্ষণ ধরিয়া উচ্চারণ করেন ? বাংলা ব্যবহারে ইহার মাত্রা ছয়- সংস্কৃতমতে ষোলো। তিনি যদি পাণিনির প্রতি সম্মান রাখিবার জন্য ষোলো মাত্রায় সা-ত-সা-ত্তে-উ-না-প-ইিঞ্চা-শ উচ্চারণ করিতেন, তবে তাহার অপেক্ষা নির্বোধি ছেলে দ্রুত আওড়াইয়া দিয়া ক্লাসে তাহার উপরে উঠিয়া যাইত। সংস্কৃত ব্যাকরণকেই যদি মানিতে হয়, তবে কেবল মাত্রায়