পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ V2O রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্ৰীযুক্ত সুবোধচন্দ্ৰ মহলানবিশ জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি কথা লিখিয়াছেন। প্রবন্ধে যে দু-একটি পারিভাষিক শব্দ আছে, তৎসম্বন্ধে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। বাংলায় এভোল্যুশন থিওরি-র অনেকগুলি প্ৰতিশব্দ চলিয়াছে। লেখক মহাশয় তাহার মধ্যে হইতে ক্ৰমবিকাশতত্ত্ব বাছিয়া লইয়াছেন । পূজ্যপাদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় এরূপ স্থলে অভিব্যক্তিবাদ শব্দ ব্যবহার করেন। অভিব্যক্তি শব্দটি সংক্ষিপ্ত ; ক্ৰমে ব্যক্ত হইবার দিকে অভিমুখভােব অভি উপসৰ্গযোগে সুস্পষ্ট ; এবং শব্দটিকে অভিব্যক্ত বলিয়া বিশেষণে পরিণত করা সহজ । তা ছাড়া ব্যক্ত হওয়া শব্দটির মধ্যে ভালোমন্দ উন্নতি-অবনতির কোনো বিচার নাই ; বিকাশ শব্দের মধ্যে একটি উৎকর্ষ অর্থের আভাস আছে। লেখক মহাশয় Natural Selection-কে বাংলায় নৈসৰ্গিক মনোনয়ন বলিয়াছেন । এই সিলেকশন শব্দের চলিত বাংলা বাছাই করা । বাছাই কাৰ্য যন্ত্রযোগেও হইতে পারে ; বলিতে পারি চা-বাছাই করিবার যন্ত্র, কিন্তু চা-মনোনীত করিবার যন্ত্র বলিতে পারি না । মন শব্দের সম্পর্কে মনোনয়ন কথাটার মধ্যে ইচ্ছা-অভিরুচির ভাব আসে। কিন্তু প্ৰাকৃতিক সিলেকশন যন্ত্রবৎ নিয়মের কার্য, তাহার মধ্যে ইচ্ছার অভাবনীয় লীলা নাই। অতএব বাছাই শব্দ এখানে সংগত। বাংলায় বাছাই শব্দের সাধু প্রয়োগ নির্বাচন । নৈসৰ্গিক নির্বাচন’ শব্দে কোনো আপত্তির কারণ আছে কি না জানিতে ইচ্ছুক, আছি। Fossil শব্দকে সংক্ষেপে ‘শিলাবিকার বলিলে কিরূপ হয় ? Fossilized শব্দকে বাংলায় শিলাবিকৃত অথবা শিলীভুত বলা যাইতে পারে। লেখকমহাশয় ইংরেজি ফসিল শব্দের বাংলা করিয়াছেন ‘প্রস্তরীভূত কঙ্কাল । কিন্তু উদ্ভিদ পদার্থের ফসিল সম্বন্ধে কঙ্কাল শব্দের প্রয়োগ কেমন করিয়া হইবে। ‘পাতার কঙ্কাল ঠিক বাংলা হয় না। ফসিলের প্রতিশব্দ শিলাবিকার হইতে পারে, এরূপ মন্তব্য প্ৰকাশ করিয়াছিলাম । কিন্তু মহলানবিশ মহাশয়ের সহিত আলোচনা করিয়া দেখিয়াছি, “শিলাবিকার'metamorphosed rock-এর উপযুক্ত ভাষান্তর হয়, এবং জীবশিলা শব্দ ফসিলের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। ‘চরিত্র নীতি” প্ৰবন্ধটির লেখক শ্ৰীযুক্ত খগেন্দ্রনাথ মিত্র। ইংরেজি Ethics শব্দকে তিনি বাংলায় চরিত্ৰনীতি নাম দিয়াছেন । অনেকে ইহাকে নীতি ও নীতিশাস্ত্র বলেন- সেটাকে লেখক পরিত্যাগ করিয়া ভালোই করিয়াছেন ; কারণ নীতি শব্দের অর্থ সকল সময়ে ধর্মানুকুল নহে। প্রহরিস্যন প্ৰিয়ং ব্রুয়াৎ, প্ৰহৃত্যাপি প্রিয়োত্তরম। অপিচাস্য শিরশিছত্ত্বা রুদ্যাৎ শোচেৎ তথাপি চ | মারিতে মারিতে কহিবে মিষ্ট, মারিয়া কহিবে আরো । মাথাটা কাটিয়া কাদিয়া উঠিবে যতটা উচে পারে । ইহাও এক শ্রেণীর নীতি, কিন্তু এথিকস নহে। সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম বলিতে মুখ্যত এথিকস বুঝায়, কিন্তু ধর্মের মধ্যে আরো অনেক গৌণ পদার্থ আছে । মৌনী হইয়া ভোজন করিবে, ইহা ব্ৰাহ্মণের ধর্ম হইতে পারে। কিন্তু ইহা এথিকস নহে। অতএব চরিত্রনীতি শব্দটি উপযুক্ত হইয়াছে, কিন্তু ইহাকে আর-একটু সংহত করিয়া 'চারিত্র বলিলে ব্যবহার পক্ষে সুবিধাজনক হয়। চরিত্রনীতিশিক্ষা, চরিত্রনীতিবােধ, চরিত্রনৈতিক উন্নতি অপেক্ষা চারিত্রশিক্ষা’, ‘চরিত্ৰবোধ’, ‘চরিত্রোন্নতি’ আমাদের কাছে সংগত বোধ হয় - আর-একটি কথা জিজ্ঞাস্য, metaphysics' শব্দের বাংলা কি “তত্ত্ববিদ্যা' নহে। ] লেখক মহাশয় সেনট্রপীটাল ও সেনট্ৰফুটুগাল ফোর্স-কে কেন্দ্রাভিসারিনী ও কেন্দ্ৰাপগামিনী শক্তি বলিয়াছেন- কেন্দ্ৰানুগ এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তি আমাদের মতে সংক্ষিপ্ত ও সংগত । বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা স্থির হয় নাই, অতএব পরিভাষার প্রয়োগ লইয়া আলোচনা কর্তব্য।