পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় । ԳԵ"\Ծ) “আপনি যাহা বলিয়াছেন সে কথা সত্য । সকল ধর্মসমাজেই এমন অনেক পুরাতন প্ৰথা সঞ্চিত হইতে থাকে যাহার ভিতর হইতে প্ৰাণ সরিয়া গিয়াছে। অথচ চিরকালের অভ্যাস-বশত মানুষ তাহাকেই প্ৰাণের সামগ্ৰী বলিয়া আঁকড়িয়া থাকে- তাহাতে কেবলমাত্র তাহার অভ্যাস তৃপ্ত হয়, কিন্তু তাহার প্রাণের উপবাস ঘুচে না- এমনি করিয়া অবশেষে এমন একদিন আসে যখন ধর্মের প্রতিই তাহার অশ্রদ্ধা জন্মে- এ কথা ভুলিয়া যায় যাহাকে সে আশ্রয় করিয়াছিল তাহা ধর্মীই নহে, ধর্মের পরিত্যক্ত আবর্জনা মাত্র । “এমন অবস্থায় সকল দেশেই সকল কালেই মানুষকে কেহ-না-কেহ শুনাইয়াছে যে, আচারই ধর্ম নহে, বাহ্যিকতায় অস্তরের ক্ষুধা মেটে না এবং নিরর্থক অনুষ্ঠান মুক্তির পথ নহে, তাহা বন্ধন । অভ্যাসের প্রতি আসক্ত মানুষ কোনো দিন এ কথা শুনিয়া খুশি হয় নাই এবং যে এমন কথা বলে তাহাকে পুরস্কৃত করে নাই- কিন্তু ভালো লাগুক আর না লাগুক এ কথা তাহাকে বারংবার শুনিতেই হইবে । r “প্রত্যেক মানুষের একটা অহং আছে। সেই অহং'এর আবরণ হইতে মুক্ত হইবার জন্য সাধকমাত্রের একটা ব্যগ্ৰতা আছে। তাহার কারণ কী । তাহার কারণ এই, মানুষের নিজের বিশেষত্ব যখন তাহার। আপনাকেই ব্যক্ত করিতে থাকে, আপনার চেয়ে বড়োকে নহে, তখন সে আপনার অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে । আপনার অহংকার, আপনার স্বার্থ, আপনার সমস্ত রাগদ্বেষকে ভেদ করিয়া ভক্ত যখন আপনার সমস্ত চিন্তায় ও কমে ভগবানের ইচ্ছাকে ও তাহার আনন্দকেই প্ৰকাশ করিতে থাকেন তখন র্তাহার মানবজীবন সার্থক হয় । ‘ধর্মসমাজেরও সেইরূপ একটা অহং আছে । তাহার অনেক রীতি-পদ্ধতি নিজেকেই চরমরূপে প্ৰকাশ করিতে থাকে । চিরন্তনকে আচ্ছন্ন করিয়া নিজের অহংকারকেই সে জয়ী করে। তখন তাহাকে পরাভূত করিতে না পারিলে সত্যধর্ম পীড়িত হয় । সেই পীড়া যে সাধক অনুভব করিয়াছে সে এমন গুরুকে খোজে যিনি এই সমস্ত সামাজিক অহংকে অপসারিত করিয়া ধর্মের মুক্ত স্বরূপকে দেখাইয়া দিবেন । মানবসমাজে যখনই কোনো শুরু আসিয়াছেন তিনি এই কাজই করিয়াছেন । x, “আপনি প্রশ্ন করিয়াছেন, উপায় কী । “শুধু আলো, শুধু গ্ৰীতি’ লইয়াই কি মানুষের পেট ভরিবে । অর্থাৎ আচার-অনুষ্ঠানের বাধা দূর করিলেই কি মানুষ কৃতাৰ্থ হইবে । তাই যদি হইবে তবে ইতিহাসে কোথাও তাহার কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না কেন । “কিন্তু এরূপ প্রশ্ন কি অচলায়তনের লেখককে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হইয়াছে । অচলায়তনের গুরু কি ভাঙিবার কথাতেই শেষ করিয়াছেন । গড়িবার কথা বলেন নাই ? পঞ্চক যখন তাড়াতাড়ি বন্ধন ছাড়াইয়া উধাও হইয়া যাইতে চাহিয়াছিল তখন তিনি কি বলেন নাই ‘না, তা যাইতে পরিবে না- যেখানে ভাঙা হইল। এইখানেই আবার প্রশস্ত করিয়া গড়িতে হইবে ? গুরুর আঘাত নষ্ট করিবার জন্য নহে, বড়ো করিবার জন্যই । তাহার উদ্দেশ্য ত্যাগ করা নহে, সার্থক করা । মানুষের স্কুল দেহ যখন মানুষের মনকে অভিভূত করে তখন সেই দেহগত রিপুকে আমরা নিন্দা করি, কিন্তু তাহা হইতে কি প্রমাণ হয় প্রেতত্ব লাভই মানুষের পূর্ণতা । স্কুল দেহের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই দেহ মানুষের উচ্চতর সত্তার বিরোধী হইবে না, তাহার অনুগত হইবে, এ কথা বলার দ্বারা দেহকে নষ্ট করিতে বলা হয় না । ‘অচলায়তনে মন্ত্রমাত্রের প্রতি তীব্ৰ শ্লেষ প্ৰকাশ করা হইয়াছে। এ কথা কখনোই সত্য হইতে পারে না, যেহেতু মন্ত্রের সার্থকতা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু মন্ত্রের যথার্থ উদ্দেশ্য মননে সাহায্য করা । ধ্যানের বিষয়ের প্রতি মনকে অভিনিবিষ্ট করিবার উপায় মন্ত্র । “কিন্তু সেই মন্ত্রকে মনন-ব্যাপার হইতে যখন বাহিরে বিক্ষিপ্ত করা হয়, মন্ত্র যখন তাহার