পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় Գեr@ “আমার লেখা পড়িয়া অনেকে বিচলিত হইবেন এ কথা আমি নিশ্চিত জনিতাম ; আমি শীতলাভোগের বরাদ। আশাও করি নাই । অচলায়তন লেখায় যদি কোনো চঞ্চলতাই না আনে তবে উহা বৃথা লেখা হইয়াছে বলিয়া জানিব। সংস্কারের জড়তাকে আঘাত করিব, অথচ তাহা । আহত হইবে না, ইহাকেই বলে নিস্ফলতা। অবস্থাবিশেষে ক্রোধের উত্তেজনাই সত্যকে স্বীকার করিবার প্রথম লক্ষণ, এবং বিরোধই সত্যকে গ্ৰহণ করিবার আরম্ভ। যদি কেহ এমন অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া কথা বলেন ও বিশ্বাস করেন যে, জগতের মধ্যে কেবল আমাদের দেশেই ধর্মে ও সমাজে কোথাও কোনো কৃত্রিমতা ও বিকৃতি নাই, অথচ বাহিরে দুৰ্গতি আছে, তবে সত্যের সংঘাত তাহার পক্ষে সুখকর হইবে না, তিনি সত্যকে আপনার শত্রু বলিয়া গণ্য করবেন। তাহাদের মন রক্ষা করিয়া যে চলিবে হয় তাহাকে মূঢ় নয় তাহাকে ভীরু হইতে হইবে । নিজের দেশের আদর্শকে যে ব্যক্তি যে পরিমাণে ভালোবাসিবে সেই তাহার বিকারকে সেই পরিমাণেই আঘাত করিবে, ইহাই শ্রেয়স্কর ৷ ভালোমন্দ সমস্তকেই সমান নির্বিচারে সর্বাঙ্গে মাখিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া থাকাকেই প্রেমের পরিচয় বলিতে পারি না । দেশের মধ্যে এমন অনেক আবর্জনা স্তুপাকার হইয়া উঠিয়াছে যাহা আমাদের বুদ্ধিকে শক্তিকে ধর্মকে চারি দিকে আবদ্ধ করিয়াছে ; সেই কৃত্রিম বন্ধন হইতে মুক্তি পাইবার জন্য এ দেশে মানুষের আত্মা অহরহ কঁদিতেছে- সেই কান্নাই ক্ষুধার কান্না, মারীর কান্না, অকালমৃত্যুর কান্না, অপমানের কান্না । সেই কান্নাই নানা নাম ধরিয়া আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটা ব্যাকুলতার সঞ্চার, করিয়াছে, সমস্ত দেশকে নিরানন্দ করিয়া রাখিয়াছে, এবং বাহিরের সকল আঘাতের সম্বন্ধেই তাহাকে এমন একান্তভাবে । অসহায় করিয়া তুলিয়াছে। ইহার বেদনা কি প্রকাশ করিব না। কেবল মিথ্যা কথা বলিব এবং সেই বেদনার কারণকে দিনরাত্রি প্রশ্রয় দিতেই থাকিব ? অস্তরে যে-সকল মর্মস্তিক বন্ধন আছে বাহিরের শৃঙ্খল তাঁহারই স্কুল প্রকাশ মাত্র । অন্তরের সেই পাপগুলাকে কেবলই বাপু বাছা বলিয়া নাচাইব, আর ধিককার দিবার বেলায় ঐ বাহিরের শিকলটাই আছে ? আমাদের পাপ আছে বলিয়াই শাস্তি আছে । যত লড়াই ঐ শাস্তির সঙ্গে ? আর, যত মমতা ঐ পাপের প্রতি ? তবে কি এই কথাই সত্য যে আমাদের কোথাও পাপ নাই, আমরা বিধাতার অন্যায় বহন করিতেছি ? যদি তাহা সত্য না হয়, যদি পাপ থাকে, তবে সে পাপের বেদনা আমাদের সাহিত্যে কোথায় প্ৰকাশ পাইতেছে ? আমরা কেবলই আপনাকে ভুলাইতে চেষ্টা করিতেছি যে, সমস্ত অপরাধ বাহিরের দিকেই । আপনার মধ্যে যেখানে সকলের চেয়ে বড়ো শক্ৰ আছে, যেখানে সকলের চেয়ে ভীষণ লড়াই প্ৰতীক্ষা করিতেছে, সেদিকে কেবলই আমরা মিথ্যার আড়াল দিয়া আপনাকে বাচাইবার চেষ্টা করিতেছি । কিন্তু আমি আপনাকে বলিতেছি, আমার পক্ষে প্ৰতিদিন ইহা অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের সমস্ত-দেশ-ব্যাপী এই বন্দীশালাকে একদিন আমিও নানা মিষ্ট নাম দিয়া ভালোবাসিতে চেষ্টা করিয়াছি ; কিন্তু তাহাতে অন্তরাত্মা তৃপ্তি পায় নাই— এই পাষাণ-প্রাচীরের চারি দিকেই তাহার মাথা ঠেকিয়া সে কোনো আশার পথ দেখিতেছে না । বাস রে !! এমন নীরন্ত্র বেষ্টন, এমন আশ্চর্য পাকা গাথনি ! বাহাদুরি আছে বটে, কিন্তু শ্রেয়-আছে কি । চারি দিকে তাকাইয়া শ্রেয় কোনখানে দেখা যাইতেছে জিজ্ঞাসা করি । ঘরে বাহিরে কোথায় সে আছে । অচলায়তনে আমার সেই বেদনা প্রকাশ পাইয়াছে। শুধু বেদনা নয়, আশাও আছে। ইতিহাসে সর্বত্রই কৃত্রিমতার জাল যখন জটিলতম দৃঢ়তম হইয়াছে তখনই গুরু আসিয়া তাহা ছেদন করিয়াছেন । আমাদেরও গুরু আসিতেছেন। দ্বার রুদ্ধ, পথ দুৰ্গম, বেড়া বিস্তর, তবু তিনি আসিতেছেন । তাহাকে আমরা স্বীকার করিব না, বাধা দিব, মারিব ; তবু তিনি আসিতেছেন। ইহা নিশ্চিত । দোহাই আপনাদের, মনে করিবেন না, অচলায়তনে আমি গালি দিয়াছি বা উপদেশ দিয়াছি। আমি প্রাণের ব্যাকুলতায় শিকল নাড়া দিয়াছি ; সে শিকল আমার, এবং সে শিকল, সকলের । নাড়া দিলে হয়তো পায়ে বাজে । বাজিবে না তো কী ! শিকল যে শিকলই সেই কথাটা যেমন করিয়া হউক জানাইতেই হইবে । যে নিজে অনুভব করিতেছে সে অনুভব না। Ve Gło * ܫ