পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bro8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহাকে নিজের আত্মাকে উপলব্ধি করিতে হইবে । তাহা হইলেই আমরা যাহা চাহিতেছি তাহা পাইব এবং পশ্চিমের সহিত প্রাচ্যের মিলন সম্পূর্ণ হইবে । সেইদিনই ভারত-ইতিহাসের এই বিরোধসংকুল বর্তমান পর্বের অবসান হইবে । পরিশিষ্টের ‘হিন্দুবিবাহ প্ৰবন্ধটি যখন সমাজ গ্রন্থের প্রচলিত সংস্করণে (পরিবর্ধিত পঞ্চম সংস্করণ) সংকলিত হয় তখন উহার অনেক অংশ বর্জিত হইয়াছিল । রবীন্দ্ৰ-রচনাবলীতে প্ৰবন্ধটির সাময়িক পত্রে প্রকাশিত পাঠ সম্পূর্ণ মুদ্রিত হইল। “আহার সম্বন্ধে চন্দ্ৰনাথবাবুর মত প্ৰবন্ধটির অনুবৃত্তিস্বরূপ নিমের আলোচনাটি সাধনার (চৈত্র ১২৯৮) সাময়িক-সাহিত্য-সমালোচনা হইতে মুদ্রিত হইল। ফায়ুনের সাহিত্য পত্রিকার 'আহার প্ৰবন্ধ সমালোচনা করিতে গিয়া রবীন্দ্ৰনাথ লিখিয়াছেন : “শ্রদ্ধাস্পদ লেখক মহাশয় বলেন, “আমাদের মহাজ্ঞানী ও সূক্ষ্মদশী শাস্ত্রকারেরা আহারকে ধর্মের অন্তৰ্গত করিয়া গিয়াছেন ।” এই ভাবের কথা আমরা অনেক দিন হইতে শুনিয়া আসিতেছি, কিন্তু ইহার তাৎপর্য সম্পূর্ণ বুঝিতে পারি না। অনেকেই গৌরব করিয়া থাকেন আমাদের আহার ব্যবহার সমস্তই ধর্মের অন্তর্ভুত- কিন্তু এখানে ধর্ম বলিতে কী বুঝায়। যদি বল, ধর্মের অর্থ কর্তব্যজ্ঞান- মানুষের পক্ষে যাহা ভালো তাঁহাই তাহার কর্তব্য, ধর্ম এই কথা বলে, তবে জিজ্ঞাসা করি সে কথা কোন দেশে অবিদিত । শরীর সুস্থ রাখা যে মানুষের কর্তব্য, যাহাতে তাহার কল্যাণ হয় তাহাই তাহার অনুষ্ঠেয় এ কথা কে না বলে। যদি বল, এ স্থলে ধর্মের অর্থ পরলোকে দণ্ডপুরস্কারের বিধান, অর্থাৎ বিশেষ দিনে বিশেষ ভাবে বিশেষ আহার করিলে শিবলোক প্ৰাপ্তি হইবে এবং না করিলে চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ হইবে, ধর্ম এই কথা বলে, তবে সেটাকে সত্যধর্ম বলিয়া স্বীকার করা যায় না। কোনো এক মহাজ্ঞানী সূক্ষ্মদশী শাস্ত্রকার লিখিয়া গিয়াছেন মধুকৃষ্ণা ত্ৰয়োদশীতে গঙ্গাস্নান করিলে ‘ত্রিকোটিকুল মুদ্ধরেৎ' ; মানিয়া লওয়া যাক উক্ত ত্ৰয়োদশীতে নদীর জলে স্নান করিলে শরীরের স্বাস্থ্যসাধন হয়, কিন্তু ইহার মধ্যে গৌরবের অংশ কোনটুকু— ঐ পুরস্কারের প্রলোভনীটুকু ? কেবল ঐ মিথ্যা প্রলোভনসূত্রে এই স্বাস্থ্যতত্ত্ব অথবা আধ্যাত্মিকতত্ত্বের নিয়মটুকুকে ধর্মের সহিত গাথা হইয়াছে। নহিলে স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম পালন করা ভালো এবং যাহা ভালো তাহাই কর্তব্য, এ কথা কোন দেশের লোক জানে না । আহারের সময় পূর্বমুখ করিয়া উপবেশন করিলে তাঁহাতে পরিপাকের সহায়তা ও তৎসঙ্গে মানসিক প্রসন্নতার বৃদ্ধিসাধন করে, অতএব পূর্বমুখে আহার করা ধর্মবিহিত, এ কথা বলিলে প্রমাণ লইয়া তর্ক উঠিতে পারে। কিন্তু মূল কথাটা সম্বন্ধে কাহারও কোনো আপত্তি থাকিতে পারে না । কিন্তু যদি বলা হয়। পূর্বমুখে আহার না করিলে অপবিত্র হইয়া ত্রিকোটিকুলাসমেত নরকে পতিত হইতে হইবে, ইহা ধর্ম, অতএব ইহা পালন করিবে, তবে এ কথা লইয়া গৌরব করিতে পারি না । যাহার সত্য-মিথ্যা প্রমাণের উপর নির্ভর করে, যে-সকল বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞানোন্নতি সহকারে মতের পরিবর্তন কিছুই অসম্ভব নহে, তাহাকে কী বলিয়া ধর্মনিয়মভুক্ত করা যায় । স্বাস্থ্যরক্ষা করা মানুষের কর্তব্য অতএব তাহা ধর্ম, এ মূলনীতির কোনোকালে পরিবর্তন সম্ভব নহে ; কিন্তু কোনো একটা বিশেষ উপায়ে বিশেষ দ্রব্য আহার করা ধর্ম, না করা অধৰ্ম, এরূপ বিশ্বাসে গুরুতর অনিষ্টের কারণ ঘটে । “মানবনীতির দুই অংশ আছে, এক অংশ স্বতঃসিদ্ধ, এক অংশ যুক্তিসিদ্ধ।।* আধুনিক সভ্য রা। এই দুই অংশকে পৃথক করিয়া লইয়াছেন ; এক অংশকে ধৰ্মনৈতিক ও অপর অংশকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। একদিকে এই ধ্রুব শক্তি এবং অপর ৯ এখানে আমরা তত্ত্ববিদ্যার তর্কে নামিতে চাহি না । বলা আবশ্যক, স্বতঃসিদ্ধ কিছু আছে বলিয়া অনেকে বিশ্বাস করেন না। : •ኳ .