পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brobr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্রবাহের গভীর তলদেশে উহাদের কোনো মূল নাই। তীরে বসিয়া ফেনের আধিক্য দেখিলে ভ্ৰম হয় তবে বুঝি আগাগোড়া এইরূপ ধবলাকার, একটু অন্তরে অবগাহন করিলেই দেখা যায় সেখানে সেই স্নিগ্ধ শীতল চিরকালের নীলাম্বুধারা । শিক্ষা যদি সেই তলদেশে প্রবেশ না করে, জীবন্ত মাতৃভাষার মধ্যে বিগলিত হইয়া চিরস্থায়িত্ব । লাভ না করে, তবে সমাজের উপরিভাগে যতই অবিশ্রাম নৃত্য করুক এবং ফেনাইয়া উঠুক। তাহা ক্ষণিক শোভার কারণ হইতে পারে, চিরন্তন জীবনের উৎস হইতে পারে না। : এ-সব কথা ইতিহাসে অনেকবার আলোচিত হইয়া গেছে, এবং অনেক ইংরেজ লেখকও এ কথা লিখিয়াছেন । জর্মনিতে যতদিন না মাতৃভাষার আদর হইয়াছিল। ততদিন তাহার যথার্থ আত্মােদর এবং আত্মোন্নতি হয় নাই। শিক্ষাসভার যে-সভ্যগণ মাতৃভাষার প্রতি আপত্তি প্ৰকাশ করেন তাহারা এ-সমস্ত উদাহরণ অবগত আছেন, সেইজন্যই কথাটা তঁহাদের বুঝানাে আরো কঠিন, কারণ, বুঝাইবার কিছু নাই । আর-একটা যুক্তি আছে। এতদিনকার ইংরেজি শিক্ষাতেও শিক্ষিতগণের মধ্যে প্রকৃত মানসিক বিকাশ দেখা যায় না। তাহারা এমন একটা-কিছু করেন নাই যাহাকে পৃথিবীর একটা নূতন উপার্জন বলা যাইতে পারে, যাহাতে মনুষ্যজাতির একটা নুতন গৌরব প্রকাশ পাইয়াছে। কেহ কেহ ভালো ইংরেজি বলেন, কেহ কেহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ রক্ষা করেন, কিন্তু ধাত্রীর অঞ্চল ছাড়িয়া কেহ এক পা ইটিতে পারেন না । তাহার প্রধান কারণ, বিদেশী ভাষার ভার বড়ো গুরুতর । একজনের খোলস আর-একজনের স্কন্ধে চাপাইলে - সে কখনোই তাহা লইয়া বেশ স্বাধীন সহজভাবে চলিতে পারে না । আমাদের ভাবকে বিদেশী ভাষার বোঝা কঁধে লইয়া চলিতে হয়, প্ৰতি পদে পদস্থলনের ভয়ে তাহাকে বড়ো সাবধানে অগ্রসর হইতে হয়, কোনোমতে মান বঁাচাইয়া বাধা রাস্তা ধরিয়া চলিতে পারিলেই তাহার পক্ষে যথেষ্ট । ” কিন্তু ততটুকু করাই এত কঠিন যে, সেইটুকু সুসম্পন্ন করিলেই পরম একটা গৌরব অনুভব করা যায়, সেটাকে খুব-একটা মহৎ ফললােভ বলিয়া ভ্ৰম হয় । অন্য দেশে একটা বড়ো কাজের যতটা মূল্য, আমাদের দেশে একটা অবিকল নকলের মূল্য তাহা অপেক্ষা অল্প নহে। এতটা করিয়া যাহা হইল তাহা যে কিছুই নহে, এ কথা লোককে বোঝানাে বড়ো শক্ত । এইজন্য মুখুজ্যের ছেলেকে গড়গড় শব্দে ইংরেজি বক্তৃতা করিতে শুনিলে বাড়ুজ্যের ছেলেকেও সেই চূড়ান্ত গৌরব হইতে বঞ্চিত করিতে তাহার বাপের প্রবৃত্তি হয় না। তখন যদি তাহাকে বুঝাইতে বসা যায় যে, বার্ক ব্ৰাইটু গ্র্যাডস্টোনের ভাষার সহিত প্রচুর পরিমাণে পানাপুকুরের জল মিশাইয়া একটি বঙ্গশাবক যে বহুকষ্টে অথবা অল্পায়াসে গোটাকতক অকিঞ্চিৎকর কথা বলিয়া গেল, উহাতে কোনো কাজই হইল না, উহা না। আমাদের দেশের অন্তঃকরণে স্থায়ী হইল, না বিলাতি সাহিত্যে প্রবেশ লাভ করিল- কেবল নিস্ফল শিলাবৃষ্টির ন্যায় অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী চাটুপটু শব্দের করতালি আকর্ষণ করিয়া শস্যবীজহীন পথিকৰ্দমের সহিত মিশাইয়া গেল ; উহা অপেক্ষা বাংলাভাষায় ভােব প্ৰকাশ করিবার চেষ্টারও সহস্ৰগুণ সফলতা আছে - তবে এ-সব কথা বাড়ুজ্যের কর্ণে স্থান লাভ করে না, মুখুজ্যের ছেলের ইংরেজি ফাকা আওয়াজের কাছে স্বদেশের সমস্ত দাবি তাহার নিকট এতই ক্ষীণ বলিয়া প্ৰতীয়মান হয় । বুঝাইবার পক্ষে আর-একটা বড়ো বাধা আছে। অনেকে এমন কথা মনে করেন, আমরাও তো আধুনিক প্ৰণালীতে শিক্ষালাভ করিয়াছি ; কই আমাদের মানসিক ঔৎকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের মনে তো কখনো তিলমাত্র সংশয় উপস্থিত হয় না। বুঝিতে পড়িতে কহিতে বলিতে আমরা তো বড়ো কম নহি । সে কথা অস্বীকার করিয়া কাজ নাই। তাহাদিগকে বলা যাক, আপনারা কিছুতেই নতুন নহেন । কিন্তু আরো ঢের বেশি হইতে পারিতেন। এখনই যদি আপিসের কাজ সুশৃঙ্খলমত।