পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

b. У О রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অবশ্য, ওরিজিন্ন্যালিটি না থাকিলেও কাজ চলিয়া যায়, কারণ উহা বাড়ার ভাগ মাত্র । কিন্তু একটা কাজ সমাধা করিতে ঠিক যতটা শক্তির আবশ্যক তদপেক্ষা কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হাতে রাখিতেই হয় । দুইশো জনকে যজ্ঞে নিমন্ত্ৰণ করিলে ন্যূনপক্ষে আড়াইশো জনের মতো আয়োজন করিতে হয় । সমাজের সকল বিভাগে যখন এই বাড়তি ভাগ, এই ওরিজিন্ন্যালিটি, এই প্ৰতিভা প্ৰত্যক্ষগোচর হয়, তখন স্পষ্ট বুঝা যায়, সমাজের সমস্ত অবশ্য প্রয়োজনীয় কার্য অনায়াসে সম্পন্ন হইতেছে । অতএব ওরিজিন্ন্যালিটি সমাজের সচ্ছলতা ও জীবনীশক্তির একটা क्लकe । 啤 পরন্তু, আমাদের শিক্ষায় আমাদের অত্যাবশ্যকটুকুই ভালো করিয়া চলে না, ওরিজিন্ন্যালিটির অভাবই তাহার প্রধান প্ৰমাণ । যেখানে বড়োলোক আছে সেখানে ছোটো কাজ রীতিমত চলিতেছে । যতক্ষণ অপৰ্যাপ্ত না হয় ততক্ষণ সমাজের পক্ষে পর্যাপ্ত হয় না । দেশী ভাষায় যদি আমরা শিক্ষালাভ করিতে পারিতাম, তবে সে-শিক্ষা আমাদের পক্ষে অপৰ্যাপ্ত হইত । আমরা তাহার মধ্যে যথেচ্ছ বিচরণ সঞ্চরণ করিতে পারিতাম, তাহার মধ্যে বাস করিতে পারিতাম এবং ক্রীড়া করিতেও পারিতাম । তাহার মধ্যে কাজও পাইতাম অবকাশও পাইতাম, সেও আমাকে গঠন করিত আমিও তাঁহাকে গঠন করিতাম । শিক্ষা এবং মনের মধ্যে খুব একটা স্বাভাবিক চলাচল থাকিত । এখন, কথা হইতে পারে বাংলায় এত বই কোথায় । তবে সেই কথাই হৌক । বাংলায় যাহাতে পাঠ্য বই হয়। সেই চেষ্টা করা যাক । সিণ্ডিকেট-সভা। যদি প্ৰসন্ন হন, যদি অনুমতি করেন, তবে দরিদ্র বাঙালি এ কাজে এখনই নিযুক্ত হয় । ম্যাকমিলান সাহেবকে অনেককাল অন্ন জোগাইয়াছি, এখন ঘরের অন্ন ঘরের উপবাসী ছেলেদের মুখে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ উঠিলে দেখিয়াও চক্ষু সার্থক হইবে । ওরিজিনাল কেতাব না পাওয়া যায় তো তৰ্জমা করিতে দোষ নাই। জ্ঞান বিজ্ঞান যেখানকারই হউক, ভাষা মাতার হওয়া চাই । শিক্ষাকে এমন আকারের পাওয়া চাই যাহাতে শিক্ষা সুস্থ শরীরের পরিণত রক্তের মতো সহজে সমাজের আপামর সাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত হইতে পারে, কেবল সংকীর্ণ স্থানবিশেষে বদ্ধ হইয়া একটা অত্যন্ত রক্তবর্ণ প্ৰদাহ উপস্থিত না করে । কিন্তু বোধ করি প্রধান আপত্তি এই যে শিশুকাল হইতে সমস্ত শিক্ষা ইংরেজিভাষায় নির্বাহ না হইলে বাঙালির ছেলে ভালো করিয়া ইংরেজি শিখিতে পরিবে না । চোর মনে করে, যত অধিক পরিমাণে লইব তত শীঘ্র শীঘ্ৰ চুরি শেষ হইবে । থলির মুখ সংকীর্ণ, তাহার মধ্যে দুই হাত প্ৰবেশ করাইয়া দেয় ; বহুলোভে দুই মুঠা ভরিয়া যখন হাত বাহির করিতে চায় তখন হাত বাহির হয় না, অবশেষে মুঠা হইতে অধিকাংশ চৌর্য সামগ্ৰী যখন পড়িয়া যায়। তখন হাত বাহির হইয়া আসে । আমাদের শিক্ষা-থলির প্রবেশপথও বড়ো সংকীর্ণ, কারণ, সে-থলি বিদেশী ভাষা । তাহার মধ্যে দুই মুঠা ভরিয়া আমরা লুণ্ঠন করিতে চেষ্টা করি, কিন্তু যখন হাত টানিয়া লই তাহাতে কতটুকু অবশিষ্ট থাকে ! বোঝা ভারী করা সহজ, বহন করাই শক্ত । সরল হইতে ক্ৰমে দুরূহে অধিরোহণ করাই শিক্ষার অভিক্ৰম । শিক্ষার পদ্ধতিটি আয়ত্ত করাই শিক্ষার একটি প্রধান বাধা, সেই ছাঁচটি একবার গড়িয়া লইতে পারিলে অনেক কঠিন শিক্ষা সহজ হইয়া আসে। ব্যাকরণশিক্ষা ভাষাশিক্ষার একটি প্ৰণালী । কিন্তু যে-ভাষার কিছুই জানি না সেই ভাষার ব্যাকরণ হইতেই যদি প্রথম ব্যাকরণ শিক্ষা হুয়, তবে শিশুদের মস্তিষ্কের প্রতি কী অন্যায় উৎপীড়ন করা হয়। কর্তা কর্ম ক্রিয়া প্রভৃতি অ্যাবস্ট্রাই শব্দগুলি ছেলেদের পক্ষে কত কঠিন সকলেই জানেন ; উপর্যুপরি সহজ উদাহরণের দ্বারা ব্যাকরণের কঠিন,সূত্রগুলি