পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় brN) S0 আমাদের দেশে শিক্ষার ভার র্যাহাদিগের হস্তে ন্যস্ত আছে, তাহাদের স্বার্থের সঙ্গে ছাত্রদের স্বার্থের বিরোধ। সুতরাং ছাত্রেরা যে সকল সময় সকল বিষয়ে শিক্ষাগুরুদিগের অনুবতী হইয়া চলিবে, তাহা সম্ভবপরও নহে, সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকরও নহে। সকলেই জানেন যে, মুখগহবর নিশ্বাস গ্রহণের জন্য অভিপ্রেত হয় নাই, নাসাই নিশ্বাস গ্রহণের প্রকৃত দ্বার। কিন্তু যখন ফুসফুস বিকৃত হইয়া পড়ে, তখন মুখগহ্বরকেই সেই কাজ করিতে হয় । সমাজে যদি কখনো এমনতরো অবস্থা উপস্থিত হয় যে, তাহার নাসা যথানিদিষ্ট কাজ করিতে পারিতেছে না, তখন কি বলিব যে তার মুখ বন্ধ হইয়া থাকুক। ছাত্রেরা যদি আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে বর্তমান আন্দোলনে যোগ দিয়া থাকেন, তবে সে আনন্দেরই কথা । এই স্বদেশী আন্দোলন যে কৃত্রিম, সে কথা তো কেহ বলিতে পরিবে না। আজ যে ছাত্রেরা উন্মত্ত, জনসাধারণ উত্তেজিত এবং বৃদ্ধেরাও উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছেন, ইহাতে স্পষ্টই মনে হয় যে, সকলে মিলিয়া দেশকে এক মহাসঙ্কট হইতে রক্ষা দেশকলপাত্রভেদে যে অবস্থার ভেদ হয়, তাহা বিবেচনা করেন না । আমাদের দেশের চাষাদিগকেও যদি আজ জিজ্ঞাসা করা যায়, “তোমরা স্বদেশী জিনিস ব্যবহার করিতেছ। কেন ।” তবে তাহারা বলে “হুকুম হইয়াছে । হুকুমই বটে, কিন্তু এ হুকুম তো কোনো নেতার হুকুম নয় । কোন স্বৰ্গ হইতে এ হুকুম নামিয়া আসিয়াছে কে বলিতে পারে। যে শক্তি আজ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে, কই, পূর্বে তো কখনো তাহা উপলব্ধি করিতে পারি নাই। তাই আমার মনে হয় যে, এ হুকুম অমান্য করিতে পারে এমন শক্তি কাহারও নাই । সুতরাং আজ যে গবমেন্টের পরোয়ানায় আপনাদের তরুণ হৃদয় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে, আমি তাহার কোনো ঠাণ্ডা চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে চাই না । আমি এ বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে এক । আপনারা স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়া— শুধু যোগ দিয়া নয়, বয়স্কদের মধ্যেও ইহা সঞ্চারিত করিয়া- বিধাতার হুকুম পালন করুন, প্রবীণেরা তাহাতে কোনো বাধা দিবেন না । আবশ্যক হইলে দেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্রব পর্যন্ত পরিত্যাগ করবেন, আপনারা এই প্ৰস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন । এই অপমানকার [সরকারী] পরোয়ানায় আপনারা যে ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছেন, আমি তাহা দেখিতে পাইতেছি । আপনারা যে এ সংকল্প রক্ষা করিতে পরিবেন, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই । আপনাদের কর্তব্য আপনারা করিয়াছেন । এখন প্ৰবীণ লোকদিগের কর্তব্য আপনাদিগকে যথার্থভাবে চালনা করা । যদি এই অপমানে আপনারা সত্য সত্যই ক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত হইয়া থাকেন, তবে প্ৰবীণ ব্যক্তিরা আপনাদিগকে কখনো পরিত্যাগ করিতে পরিবেন না । এখন তাহারা নিঃসন্দেহই চিন্তা করিতেছেন- কী উপায়ে ইহার প্রতিকার হইতে পারে । কর্তৃপক্ষের তাড়নায় ছাত্ৰগণ বেদনা বোধ করিয়া যে এতদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছেন, গবমেন্টের চাকরি ও গবমেন্টের সম্মানের আশা বিসর্জন দিয়া স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষা করিতেছেন, ইহা অত্যন্ত শুভলক্ষণ বলিতে হইবে । আমাদের সমাজ যদি নিজের বিদ্যাদানের ভার নিজে না গ্ৰহণ করেন, তবে একদিন ঠেকিতেই হইবে । আজকার এই অবমাননা যে নুতন, তাহা নহে ; অনেকদিন হইতেই ইহার সূত্র আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উচ্চশিক্ষার উপর গবর্মেন্টের অনুকুল দৃষ্টি নাই ; সুতরাং গবমেন্ট যদি এই পরোয়ানা প্রত্যাহারও করেন, তবুও আমরা তাহদের হাতে শিক্ষার ভার সমৰ্পণ করিয়া শান্ত থাকিতে পারিব না । গবমেন্ট এ দেশের অনুকূল শিক্ষা কখনো দিতে পারেন না। ইহার কারণ অক্ষমতাও হইতে পারে, অনিচ্ছাও হইতে পারে। অক্ষমতা- কেননা যেখানে হৃদয়ের যোগ না থাকে, সেখানে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া যায় না ; অনিচ্ছা কেননা গবর্মেন্ট জানেন যে, তাহাদিগের সাহিত্য ও ইতিহাস প্রভৃতি হইতে শিক্ষা লাভ করিয়া আমাদের চিত্ত যে-ভাবে গঠিত হইয়া উঠিতেছে, তাহা তঁহাদের স্বার্থের পক্ষে