পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brSO - রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ১৩০৮ সালের অগ্রহায়ণের ভারতীতে ‘নৃতন বাংলা ব্যাকরণ’ নামক একটি প্রবন্ধে পণ্ডিত শরচ্চন্দ্ৰ শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের সুদীর্ঘ এক প্রতিবাদ প্ৰকাশ করেন । পরিষদের সপ্তম মাসিক অধিবেশনে (২৪ অগ্রহায়ণ ১৩০৮) রবীন্দ্ৰনাথ ‘বাংলা ব্যাকরণ*** প্ৰবন্ধে তাহার উত্তর দেন । শরচ্চন্দ্ৰ শাস্ত্রী, বলাইচাঁদ গোস্বামী, প্রমথ চৌধুরী, উপাধ্যায় ব্ৰহ্মবান্ধব, বীরেশ্বর পাড়ে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, রাজেন্দ্ৰ বিদ্যাভূষণ, সতীশচন্দ্ৰ বিদ্যাভূষণ, প্রমথনাথ তর্কভূষণ প্রমুখ সভ্যগণ সেদিনের আলোচনায় ও বিতর্কে যোগদান করেন। আলোচনার শেষে রবীন্দ্রনাথ যাহা বলেন নিম্নে উদ্ধৃত হইল : এত কথার পর আমার একটা কৈফিয়ত দেওয়া আবশ্যক হইতেছে । আমি বলিয়াছি বাংলা ব্যাকরণ বাংলা নিয়মে চলিবে, সংস্কৃত নিয়মে চলিবে না, এ কথার প্রতিবাদ কেন হয় বুঝি না । পণ্ডিতমহাশয়েরা মুখে যাহা বলিয়াই প্ৰতিবাদ করুন-না কেন, মনে মনে আমার কথাটা স্বীকার না করিয়া পরিবেন না । তদ্ধিত ও কৃৎ প্ৰত্যয়ন্ত কতকগুলি খাটি বাংলাশব্দ সংগ্ৰহ করিয়া আমি ইতিপূর্বে পরিষদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলাম। আমিই ব্যাকরণ লিখিতেছি বা লিখিব এরূপ দুরভিসন্ধি আমার ? আমি কতকগুলা শব্দ সংগ্ৰহ করিয়া দিয়াছি, ভবিষ্যৎ বৈয়াকরণের কার্যের জন্য উপকরণ সংগ্ৰহ করিয়া দিয়াছি বলিয়াই কি আমার এতটা অপরাধ হইয়াছে । র্যাহারা এই সকল শব্দকে slang বলিয়া ঘূণা করেন। আর ভাষার মধ্যে আমিই এই-সকল slang আমদানি করিতেছি বলিয়া আমার উপর খড়গহস্ত হইয়া উঠিতেছেন, তাহাদের একটা কথা বলিবার আছে, আমি আমদানি করিতেছি এটা কী রকম কথা । পিতৃপিতামহাদি হইতে এই সকল শব্দ কি আমরা পাই নাই। আজ সবগুলাকে কুড়াইয়া একত্ৰ করিবার চেষ্টা করিতেছি, ব্যবহার করিবেন। আপনারা । তাহাদের মধ্যে যদি সংগ্রহের দোষে দু-একটা বিজাতীয় শব্দ আসিয়া পড়িয়া থাকে, তাহাতে আপনাদের ক্ষতি কি । ব্যবহারের সময়ে বিচার করিয়া লইবেন । সংগ্ৰহকারকের হস্তে বিচারভার দিতে নাই, তাহা হইলে অনেক আসল জিনিস বাদ পড়িয়া যাইতে পারে। প্রত্যয়গুলির আমি যে-রূপ উল্লেখ করিয়া গিয়াছি সেইগুলিই প্রত্যয়ের প্রকৃত রূপ বলিয়া আমি আপনাদের গ্রাহ্য করিতে বলি না । আমার নিজেরও সে-বিষয়ে সন্দেহ যে নাই এমন নহে । আরো একটা কথা, আমি যতগুলা প্ৰত্যয়ের উদাহরণ দিয়াছি তাহা দেখিয়া আপনাদেরও কি ধারণা হয় না যে, বাংলাপ্রত্যয় বলিয়া কতকগুলা পদাৰ্থ বাস্তবিকই আছে—তা সেগুলার রূপ আমি যেরূপ নিৰ্ণয় করিয়াছি তাহাই হউক আর আপনারা বিচার করিয়া যাহা স্থির করিতে পারেন তাহাই হউক । অনেকের মনের গৃঢ় ভােব এই যে, অধিকাংশ কথাই যখন সংস্কৃত শব্দের অপভ্রংশ, তখন সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা বাংলা ব্যাকরণের কাজ কেনু চলিবে না। তাহা চলিবে না, চলিতে পারে না, তাহার কতকগুলা কারণ উদাহরণ দিয়া অদ্যকার প্রবন্ধে দেখাইয়াছি। অথবা সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম কতটা চলিবে বা না চলিবে সেটা বিচার করা আবশ্যক । আমি তো কতকগুলা প্রশ্ন ও কতকগুলা সন্দেহ লইয়া আপনাদের সম্মুখে খাড়া করিয়াছি । সেগুলার উত্তর দেওয়া বা মীমাংসা করার ভার আপনাদের । ম্যালেরিয়া কিসে যায় জিজ্ঞাসা করিলেই যদি প্রশ্নকর্তাকে ম্যালেরিয়ার প্রতিকার করিতে হয় তা হইলে ম্যালেরিয়া দূর করা আর ঘটে না । সুতরাং শরচ্চন্দ্ৰ শাস্ত্রী মহাশয় যেভাবে আমার প্রতিবাদ করিয়াছেন তাহাতে কাৰ্য সিদ্ধ হইবে না । আমি যাহা বলিয়াছি তাহার মীমাংসা আবশ্যক । আমার গলদ যথেষ্ট আছে কিন্তু তাই বলিয়া তাহাতে আসল কথার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হইল। বাংলা ব্যাকরণে কতটা পরিমাণ সংস্কৃত নিয়মাদি চলিবে বা চলিবে না। তাহা নির্ণয় করা আবশ্যক। আমার শব্দসংগ্ৰহ দেখিয়া র্যাহারা ভাবিতেছেন যে, ভাষা হইতে সংস্কৃত শব্দগুলির চিরনির্বাসনের জন্য আমরা বদ্ধপরিকর হইয়াছি তাহারা ভুল করিয়াছেন। কিছুই আত্যন্তিক রকম ভালো বলি না। সংস্কৃত শব্দের ৩০ দ্রষ্টব্য : রবীন্দ্র-রচনাবলী, বর্তমান খণ্ড (প্রচলিত দ্বাদশ খণ্ড), পরিশিষ্ট ।