পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় trNVO পণ্ডিত সতীশচন্দ্ৰ বিদ্যাভূষণ মহাশয় যে-সকল কথার উল্লেখ করিয়াছেন, তজন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি । বাংলাভাষার আকৃতি কিরূপ হইলে ভালো হয়, সে সম্বন্ধে আমার মত যে কী, তাহা আমি এ প্রবন্ধে বলি নাই, বলিতে আসিও নাই। সংস্কৃতভাষার সাহায্য ভিন্ন বাংলাভাষা যে সুসংগতভাবে প্রকাশ করা যায়, তাহা বিশ্বাস করি না । আমার এ প্ৰবন্ধ ব্যাকরণমূলক । চলিত কথাগুলির মধ্যে ব্যাকরণের যে-একটি সূক্ষ্ম সূত্র বর্তমান আছে, আমি তাহাই টানিয়া বাহির করিয়া আপনাদের দেখাইতেছি। আপনারা দেখুন, আমি যাহা বাহির করিয়াছি তাহা ঠিক কি না, তাহা টেকে কি না । কেহ যেন মনে না করেন, আমি এই সকল শব্দ অবাধে যেখানে-সেখানে সাহিত্যে ব্যবহার করিতে চাই । আমি সে-পক্ষে বিধান দিবার চেষ্টা করি নাই । ভাষায় যাহা আছে আমি তাহাই ব্যাখ্যা করিতে প্ৰয়াস পাইয়াছি । লিখিত ভাষায় এ-সকল শব্দ চলিবে কি না তাহা বিচাৰ্য । আবশ্যক হয় চলিয়া যাইবে । প্ৰাদেশিকতা। কথিত ভাষায় আছে। সত্য, কিন্তু এই প্রাদেশিকতাগুলি কি আলোচ্য নহে। আমারও চেষ্টা আছে এবং পরিষৎও চেষ্টা করিতেছেন। সমস্ত প্রাদেশিক শব্দ সংগ্ৰহ করিতে পারিলে, ভাষার অভিধানাদি কি পূর্ণাবয়ব হইবে না । আমি তো বলিয়াছি আমি এই প্রদেশের শব্দ লইয়াই আলোচনা করিয়াছি । আমার কার্যস্বতন্ত্র নহে, আমি পরিষদের চেষ্টাকেই অগ্রসর করিয়া দিতেছি। সংস্কৃত শব্দসকল বাংলায় ব্যবহারে বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের সহিত আমার মতভেদ নাই। বিদ্যাভূষণ মহাশয় বলেন ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলি পরিবর্তনশীল, কিন্তু আমার বিশ্বাস এগুলি সহজে পরিবর্তনীয় নহে। বড়ো বড়ো কথাগুলির অর্থ, ভাব ও ব্যবহারই পরিবর্তিত হইয়া থাকে। সংস্কৃত অনেক শব্দ বাংলায় পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে, তাহার উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। ধ্বন্যাত্মিক শব্দ পরিবর্তিত হইবে কেন । বাঙালি কি খিলখিল করিয়া হাসিবে না, প্যান প্যান করিয়া কঁদিবে না, ঘ্যান ঘ্যান করিয়া চাহিবে না ? প্রকৃত বাংলা লিখিত ভাষায় যে আমি চালাইতে চাহি, তাহা নহে ; তবে চলিবে কি না, তাহাদের প্রয়োজন হইবে কি না বা আছে কি না, তাহার বিচারক পাঠকগণ । পরিশিষ্ট্রের ‘প্রাকৃত ও সংস্কৃত প্ৰবন্ধটি সম্পাদকীয় মন্তব্যরূপে বঙ্গদর্শনে (১৩০৮) প্ৰকাশিত হয়। শ্ৰীনাথবাবুর প্রবন্ধে যে-উদাহরণের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করিয়াছেন নিম্নে তাহা উদ্ধৃত হইল : ৫০-৬০ বৎসর পূর্বে যে-সকল বাংলা পুস্তক লিখিত হইয়াছে তাহাতে পর্যন্ত বাংলাকে প্রাকৃত বলা হইয়াছে । যথা হয়, না সে ভাষা চলে ? শেকসপিয়রের ভাষা, ড্রাইডেনের ভাষা এখনকার ইংরেজিসাহিত্যে অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছে। শেকসপিয়র অপেক্ষা ড্রাইডেন আধুনিক । তাহার শব্দগুলা পর্যন্ত অব্যবহার্য হইয়া যাইতেছে। যোগ্যতমের উদবর্তন ভাষাতত্ত্বেও খাটে । রবীন্দ্ৰবাবু এই সকল শব্দকে চিরস্থায়ী করিতে চেষ্টা পান নাই। শব্দকে স্থায়ী করিতে কেহ পারে না । মহাকবি-প্রয়োগে কতকটা হয়, সম্পূর্ণ হয় না। শেকসপিয়র তাহার উদাহরণ । বিভক্তিও ভাষার ইঙ্গিত । ইংরেজিতে বিভক্তির preposition পূর্বনিপাত এবং বাংলায় পরনিপাত (post-position) হয় । যেমন ‘to me” ও “গাছ-থেকে । রবীন্দ্রবাবু কবির দৃষ্টিতে মাতৃভক্তের ভক্তিতে এই সকল আবিষ্কার করিয়াছেন। খুটুখািট শব্দ নুটুনটু হইয়া গেলে আত্মার দেহান্তর গ্ৰহণবৎ হয়। রবীন্দ্রবাবু আমাদের চিরপরিচিত শব্দগুলিকে বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীতে দেখিয়াছেন এবং দেখাইয়াছেন। এই সকল শব্দের ভাষায় বহুল ব্যবহার হইবে কি না তাহা আর এখন জিজ্ঞাস্য হইতে । পারে না। নাটকে এই সকল শব্দ গৃহীত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। সুরচিত নাটক ভাষায় বহুকাল থাকিবে । বৈজ্ঞানিকের চক্ষে কিছুই নগণ্য হইতে পারে না। সেইরূপ ভাষাতত্ত্ববিদের নিকট কোনো শব্দই উপেক্ষিত হইবার নহে। ব্যাকরণ আইননিগড় নয়। ভাষার স্বরূপ, ভাষার ইঙ্গিত, বিভক্তি প্রভৃতিকে ব্যাকরণ বৈজ্ঞানিক ভাবে দেখাইয়া দেয় । সিংহ বৰ্ণনায় কেশর বাদ দেওয়া যাহা, লাজুল বাদ দেওয়া তাহা । ধন্বন্যাত্মিক শব্দ বাদ দিলে ভাষাতত্ত্বালোচকের দৃষ্টি ভ্রান্ত হইবে । -হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।