পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

€$$ রবীন্দ্র-রচনাবলী আসিয়া থামিয়া গেল এবং একটা উত্তর শুনিতে পাইলাম, ‘আমি । আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুজিতে আসিয়াছি।’ আমি ভাবিলাম, নিজের কাল্পনিক স্বষ্টির কাছে ভয় দেখানে কিছু নয়— পাশবালিশটা সবলে অঁাকড়িয়া ধরিয়া চিরপরিচিতের মতো অতি সহজ সুরে বলিলাম, ‘এই দুপর রাত্রে বেশ কাজটি বাহির করিয়াছ । তা, সে কঙ্কালে এখন আর তোমার অবিশ্বক ? অন্ধকারে মশারির অত্যন্ত নিকট হইতে উত্তর আসিল, বল কী । আমার বুকের হাড় যে তাহারই মধ্যে ছিল। আমার ছাব্বিশ বৎসরের যৌবন যে তাহার চারি দিকে বিকশিত হইয়াছিল— একবার দেখিতে ইচ্ছা করে না ?” আমি তৎক্ষণাৎ বলিলাম, ই, কথাটা সংগত বটে। তা, তুমি সন্ধান করে গে যাও। আমি একটু ঘুমাইবার চেষ্টা করি। সে বলিল, ‘তুমি একলা আছ বুঝি ? তবে একটু বসি। একটু গল্প করা যাক । পয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমিও মানুষের কাছে বসিয়া মানুষের সঙ্গে গল্প করিতাম। এই পয়ত্রিশট বৎসর আমি কেবল শ্মশানের বাতাসে তুহু শব্দ করিয়া বেড়াইয়াছি। আজ তোমার কাছে বসিয়া আর-একবার মানুষের মতো করিয়া গল্প করি ? অনুভব করিলাম, আমার মশারির কাছে কে বসিল । নিরুপায় দেখিয়া আমি বেশ একটু উৎসাহের সহিত বলিলাম, সেই ভালো। যাহাতে মন বেশ প্রফুল্ল হইয় উঠে এমন একটা-কিছু গল্প বলে ।” সে বলিল, “সব চেয়ে মজার কথা যদি শুনিতে চাও তো আমার জীবনের কথা বলি |’ গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দুটা বাজিল — ‘যখন মানুষ ছিলাম এবং ছোটো ছিলাম তখন এক ব্যক্তিকে যমের মতো ভয় করিতাম । তিনি আমার স্বামী। মাছকে বড়শি দিয়া ধরিলে তাহার যেমন মনে হয় আমারও সেইরূপ মনে হইত। অর্থাৎ, কোন এক সম্পূর্ণ অপরিচিত জীব যেন বড়শিতে গাথিয়া আমাকে আমার স্নিগ্ধগভীর জন্মজলাশয় হইতে টান মারিয়া ছিনিয়া লইয়া যাইতেছে— কিছুতে তাহার হাত হইতে পরিত্রাণ নাই। বিবাহের দুই মাস পরেই আমার স্বামীর মৃত্যু হইল এবং আমার আত্মীয়স্বজনেরা আমার হইয়া অনেক বিলাপপরিতাপ করিলেন । আমার শ্বশুর অনেকগুলি লক্ষণ মিলাইয়া দেখিয়া শাশুড়িকে কহিলেন, শাস্ত্রে যাহাকে বলে বিষকন্যা এ মেয়েটি তাই । সে কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে — শুনিতেছ ? কেমন লাগিতেছে।”