পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 8○。 কিছুই ভরতে পারে না। রাজাকে নমস্কার করলে তার লাভ আছে, সমাজকে নমস্কার করলে তার সুবিধা আছে, প্রবলকে নমস্কার করলে তার সাংসারিক অনেক আপদ এড়ায় ; কিন্তু সে যদি দলের দিকে, সমাজের দিকে, অনিমেষ নেত্র মেলেই থাকে তবে তোমাকে নমস্কার করার কথা উচ্চারণ করবারই বা তার লেশমাত্র প্রয়োজন কী আছে । প্রয়োজন যে একমাত্র তারই যে আমার ভিতরের মানুষ— সে যে নিত্য মানুষ, সে তো সংসারের মানুষ নয়, সে তো সমাজের কাছ থেকে ছোটো বড়ো কোনো উপাধি গ্রহণ করে সেই চিহ্নে আপনাকে চিহ্নিত করে না । তার চরম প্রয়োজন সকলের সঙ্গে আপনাকে এক করে জানা ; তা হলেই সে আপনাকে সত্য জানতে পারে ; সেই সত্য জানা থেকে বঞ্চিত হলেই সে মুহমান হয়ে অপবিত্র হয়ে জগতে বাস করে। আপনাকে সত্যরূপে জানবার জন্যেই, সমাজসংস্কারের সংকীর্ণ জালের মধ্যে নিজেকে নিত্যকাল জড়িত করে রাখবার দীনতা হতে উদ্ধার পাবার জন্যেই সে ডাকছে তার পিতাকে, সে ডাকছে নিখিল মানুষের পিতাকে ; সেই তার পিতার বোধের মধ্যেই তার আপনার বোধ সত্য হবে, তার বিশ্বের সম্বন্ধ সম্পূর্ণ হবে। এ ডাক সমাজের ডাক নয়, সম্প্রদায়ের ডাক নয়, এ ডাক অন্তরাত্মার ডাক। এ ডাক কুলশীলের ডাক নয়, মানসন্ত্রমের ডাক নয়, এ ডাক সন্তানের ডাক । এই একটিমাত্র ডাকেই সকল সস্তানের কণ্ঠ এক সুরে মেলে, এই ‘পিতা নোহসি । তাই এ ডাকের সঙ্গে কোনো অহংকার কোনো সংস্কারকে মেলাতে গেলেই এই পরম সংগীতকে এক মুহূর্তেই বেম্বরে করা হবে ; তাতে আত্মা পীড়িত হবে এবং হে পরমাত্মন, তাতে তোমাকেই বেদন দেওয়া হবে যে তুমি সকল সস্তানের ব্যথার ব্যৰ্থ । তাই তোমার কাছে অন্তরের এই অন্তরতম প্রার্থনা, যেন নত হই, নত হই । সেই নতি দীনতার নতি নয়, সে যে পরম পরিপূর্ণতার প্রণতি। তোমার কাছে সেই একান্ত নমস্কার আত্মসমর্পণের পরমৈশ্বর্য । আমাদের সেই নমস্কার সত্য হোক, সত্য হোক ; অহং শাস্ত হোক, অহংকার ক্ষয় হোক, ভেদবুদ্ধি দূর হোক, পিতার বোধ পূর্ণ হোক এবং বিশ্বভুবনে সস্তানের প্রণামের সঙ্গে পিতার বিগলিত আনন্দধারা সম্মিলিত হোক | নমস্তেহস্তু – সকল দেহ লুটিয়ে পড়ক তোমার এ সংসারে একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে। ঘনশ্রাবণমেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত সমস্ত মন থাক পড়ে থাক তব ভবনদ্বারে একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে।