পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sss রবীন্দ্র-রচনাবলী জীবন মন দিয়ে আপন করে জানি, প্রত্যহ প্রতি দিনের ঘটনার মধ্যে স্বীকার করি এবং উৎসবের দিনে বিশ্বের বাণীকে বিজয়কণ্ঠে নিয়ে তাকে ঘোষণা করি— সেই সত্যং জ্ঞানমনস্তং ব্রহ্ম, সেই শাস্তং শিবমদ্বৈতং, সেই কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ:, সেইযে এক অনেকের প্রয়োজন গভীরভাবে পূর্ণ করছেন, সেই-যে অন্তহীন জগতের আদিঅস্তে পরিব্যাপ্ত সেই-যে মহাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট র্যার সঙ্গে শুভযোগে আমাদের বুদ্ধি শুভবুদ্ধি হয়ে ওঠে। নিখিলের মাঝখানে যেখানে মানুষ তাকে মানুষের সম্বন্ধে ডাকতে পারে— পিতা মাতা বন্ধু— সেখান থেকে সমস্ত চিত্তকে প্রত্যাখ্যান করে যখন আমরা অনন্তকে ছোটো করে আপন হাতে আপনার মতে ক’রে গড়েছি তখন কী যে করেছি তা কি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট করে একবার দেখব না । যখন আমরা বলেছি 'আমাদের পরমধনকে সহজ করবার জন্যে ছোটো করব তখনই আমাদের পরমার্থকে নষ্ট করেছি। তখন টুকরো কেবলই হাজার টুকরো হবার দিকে গেছে, কোথাও সে আর থামতে চায় নি ; কল্পনা কোনো বাধা না পেয়ে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে ; কৃত্রিম বিভীষিকায় সংসারকে কণ্টকিত করে তুলেছে ; বীভৎস প্রথা ও নিষ্ঠুর আচার সহজেই ধর্মসাধনা ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে আপনার স্থান করে নিয়েছে। আমাদের বুদ্ধি অন্তঃপুরচারিণী ভীরু রমণীর মতো স্বাধীন বিচারের প্রশস্ত রাজপথে বেরোতে কেবলই ভয় পেয়েছে। এই কথাটি আমাদের বুঝতে হবে যে অসীমের অভিমুখে আমাদের চলবার পন্থাটি মুক্ত না রাখলে নয়। থামার সীমাই হচ্ছে আমাদের মৃত্যু ; আরোর পরে আরোই হচ্ছে আমাদের প্রাণ– সেই আমাদের ভূমার দিকটি জড়তার দিক নয়, সহজের দিক নয়, সে দিক অন্ধ অনুসরণের দিক নয়, সেই দিক নিয়তসাধনার দিক। সেই মুক্তির দিককে মানুষ যদি আপন কল্পনার বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে, আপনার দুর্বলতাকেই লালন করে ও শক্তিকে অবমানিত করে, তবে তার বিনাশের দিন উপস্থিত হয়। এমনি করে মানুষ যখন সহজ করবার জন্যে আপনার পূজাকে ছোটাে করতে গিয়ে পূজনীয়কে একপ্রকার বাদ দিয়ে বসে তখন পুনশ্চ সে এই দুৰ্গতি থেকে আপনাকে বাচাবার ব্যগ্রতায় অনেক সময় আর-এক বিপদে গিয়ে পড়ে— আপন পূজনীয়কে এতই দূরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখে সেখানে আমাদের পূজা পৌছতে পারে না, অথবা পৌছতে গিয়ে তার সমস্ত রস শুকিয়ে যায়। এ কথা তখন মানুষ ভুলে যায় যে অসীমকে কেবলমাত্র ছোটাে করলেও যেমন তাকে মিথ্যা করা হয় তেমনি তাকে কেবল মাত্র বড়ো করলেও তাকে মিথ্যা করা হয় ; তাকে শুধু ছোটাে করে আমাদের বিকৃতি, তাকে শুধু বড়ো করে আমাদের শুষ্কতা।