পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 8*S যা অসীমকে সীমায় আকারবদ্ধ করতে করতে এবং সীমাকে অসীমের মধ্যে মুক্তি দিতে দিতে প্রবাহিত হচ্ছে। এর থেকেই নিখিল সত্যকে আমরা নিখিলের প্রাণরূপে জানতে পারছি। বুঝতে পারছি এই সত্য সকলের মধ্যে থেকেই সকলকে অতিক্রম করে আছে বলে বিশ্বসংসার কেবলই চলার দ্বারাই সত্য হয়ে উঠছে। এইজন্ত জগতে স্থিরত্বই হচ্ছে বিনাশ, কেননা স্থিরত্বই হচ্ছে সীমায় ঠেকে যাওয়া । এইজন্যেই বলা হয়েছে : যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি নিঃস্বতং । এই যা-কিছু সমস্তই প্রাণ হতে নিঃস্থত হয়ে প্রাণেই কম্পিত হচ্ছে । তবে কি সমস্তই প্রাণ। আর, অপ্রাণ কোথাও নেই ? অপ্রাণ অাছে, কেননা দ্বন্দ্ব ছাড়া স্বষ্টি হয় না। কিন্তু, সেই অপ্রাণের দ্বারা স্বষ্টির পরিচয় নয়। প্রাণটাই হল মুখ্য, অপ্রাণটা গৌণ। আমরা চলবার সময় যখন পা ফেলি তখন প্রত্যেক পা ফেলা একটা বাধায় ঠেকে। কিন্তু চলার পরিচয় সেই বাধায় ঠেকে যাওয়ার দ্বারা নয়, বাধা পেরিয়ে যাওয়ার দ্বারা । নিখিল সত্যেরও এক দিকে বাধা, আর-এক দিকে বাধামোচন। সেই বাধামোচনের দিকেই তার পরিচয় ; সেই দিকেই সে প্রাণস্বরূপ ; সেই দিকেই সে সমস্তকে মেলাচ্ছে এবং চালাচ্ছে । যেদিন এই কথাটি আমরা ঠিকমতে উপলব্ধি করতে পেরেছি সেদিন আমাদের ভয়ের দিন নয়, ভিক্ষার দিন নয় ; সেদিন কোনো উচ্ছৃঙ্খল দেবতাকে অদ্ভুত উপায়ে বশ করবার দিন নয়। সেদিন বিশ্বের সত্যকে আমারও সত্য বলে আনন্দিত হবার দিন । সেদিন পূজারও দিন বটে। কিন্তু, সত্যের পূজা তে কথার পূজা নয়। কথায় ভুলিয়ে সত্যের কাছে তো বর পাবার জো নেই। সত্য প্রাণময়, তাই প্রাণের মধ্যেই সত্যের পূজা। আমরা প্রত্যক্ষ দেখেছি মানুষ সত্যের বর পাচ্ছে, তার দৈন্ত দূর হচ্ছে, তার তেজ বেড়ে উঠছে। কোথায় দেখেছি । যেখানে মানুষের চিত্ত অচল নয়, যেখানে তার নব নব উদযোগ, যেখানে সামনের দিকে মানুষের গতি, যেখানে অতীতের খোটায় সে আপনাকে আপাদমস্তক বেঁধেছেদে স্থির হয়ে বসে নেই, যেখানে আপনার এগোবার পথকে সকল দিকে মুক্ত রাখবার জন্যে মানুষ সর্বদাই সচেতন। জালানি কাঠ যখন পূর্ণতেজে জলে না তখন সে ধোয়ায় কিম্বা ছাইয়ে ঢাকা পড়ে। তেমনি দেখা গেছে, যে জাতি আপনার প্রাণকে চলতে না দিয়ে কেবলই বাধতে চেয়েছে তার সত্য সকল দিক থেকেই মান হয়ে এসে তাকে নির্জীব করে ; কেননা সত্যের ধর্ম জড়ধর্ম নয়, প্রাণধর্ম— চলার দ্বারাই তার প্রকাশ ।