পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

રે છે એ রবীন্দ্র-রচনাবলী বহন করেন, সুতরাং রাজাসন তীর সঙ্গে সঙ্গেই চলিতে থাকে ; এইজন্য ছাত্রকে কেবলমাত্র ছাত্র বলিয়া দেখা তাঁর পক্ষে শক্তি, তাকে প্রজা বলিয়াও দেখেন। অতএব, অতি সামান্য কারণেই অসহিষ্ণু হওয়া তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। বাঙালি ছাত্রদের মানুষ করিবার ভার কেবল তঁর নয়, ইংরেজ-রাজের প্রতিষ্ঠা রক্ষার ভারও তীর। অতএব, একে তিনি ইংরেজ, তার উপর তিনি ইস্পীরিএল সার্ভিসের অধ্যাপক, তার উপরে তিনি রাজার অংশ, তার উপরে তার বিশ্বাস তিনি পতিত-উদ্ধার করিবার জন্য আমাদের প্রতি কৃপা করিয়াই এ দেশে আসিয়াছেন- এমন অবস্থায় সকল সময়ে তীর মেজাজ ঠিক না থাকিতেও পারে। অতএব, তিনি কিরূপ ব্যবহার করিবেন। সে বিচার না করিয়া ছাত্রদেরই ব্যবহারকে আদ্ষ্টেপুষ্ঠে কঠিন করিয়া বাধিয়া দিতে হইবে। সমুদ্রকে বলিলে চলিবে না যে, তুমি এই পর্যন্ত আসিবে তার উর্ধের্ব নয়, তীরে যারা আছে তাহাদিগকেই বলিতে হইবে, “তোমরা হঠো, হঠো, আরো হঠে।” তাই বলিতেছি এ কথা সত্য বলিয়া মানিতেই হইবে যে, নানা অনিবাৰ্য্য কারণে ইংরেজ অধ্যাপক বাঙালি ছাত্রের সহিত বিশুদ্ধ অধাপকের মতো ব্যবহার করিয়া উঠিতে পারেন না। কেমব্রিজে অক্সফোর্ডে ছাত্রদের সহিত অধ্যাপকদের সম্বন্ধ কিরূপ তর্ক স্থলে আমরা সে নজির উত্থাপন করিয়া থাকি, কিন্তু তাহাতে লাভ কী! সেখানে যে সম্বন্ধ স্বাভাবিক এখানে যে তাহ{ নাহে, সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে । অতএব, স্বাভাবিক ৩য় যেখানে গর্ত আছে সেখানে শাসনের ইটপাটকেল দিয়া ভরাট করিবার কথাটাই সর্বাগ্রে মনে আসে। Αια সমস্যাটা আমাদের পক্ষে শক্তি হইয়াছে এই কারণেই । এইজন্যই আমাদের স্বদেশীয়, বিজ্ঞেরাও ছাত্রদিগকে পরামর্শ দিয়া থাকেন যে, “বাপু, তোমরা কোনোমতে এগাজামিন পাস করিয়াই সন্তুষ্ট থাকো, মানুষ হইবার দুরাশ! মনে রাখিয়ো না!! এ বেশ ভালো কথা। কিন্তু সুবুদ্ধির কথা চিরদিন খাটে না ; মানবপ্রকৃতি সুবুদ্ধির পাকা ভিতের উপরে পাথরে গাঁথিয় তৈরি হয় নাই। তাকে বাড়িতে হইবে, এইজন্যই সে কঁচা ; এইজন্যই কৃত্রিম ঘেরটাকে সে খানিকটা দূর পর্যন্ত সহ্য করে ; তার পরে প্রাণের বড় আর আপনাকে ধরি? রাখিতে পারে না, একদিন হঠাৎ বেড়া ফাটিয়া ভাঙিয়া পড়ে ; যে প্রাণ কচি তারই জয় হয়, বে: বাঁধন পাকা সে টেকে না। : অতএব, স্বভাবকে যদি কেবল এক পক্ষেই মানি এবং অপর পক্ষে একেবারেই অগ্রাহা করি তবে কিছুদিন মনে হয়, সেই এক-তরফ নিস্পত্তিতে বেশ কাজ চলিতেছে। তার পরে একদিন হঠাৎ দেখিতে পাই কাজ একেবারেই চলিতেছে না। তখন দ্বিগুণ রাগ হয় ; যা এতদিন ঠাণ্ডা ছিল তার অকস্মাৎ চঞ্চলতা গুরুতর অপরাধ বলিয়াই গণা হইতে থাকে এবং সেই কারণেই শাস্তি: মাত্ৰা দণ্ডবিধির সহজ বিধানকে ছাড়াইয়া যায়। তার পর হইতে সমস্ত ব্যাপারটা এমনি জটিল হইয়া উঠে যে কমিশনের পঞ্চায়েত তার মধ্যে পথ খুজিয়া পায় না ; তখন বলিতে বাধা হয় যে, ‘কুড়াল দিয়া কাটিয়া, আগুন দিয়া পোড়াইয়া, স্টীমরোলার দিয়া পিষিয়া রাস্তা তৈরি করে ' কথাটা বেশ। কর্ণধার কানো ধরিয়া বিকা মারিতে মারিতে স্কুলের খেয়া পার করিয়া দিল, তার পরে লৌহশাসনের কলের গাড়িতে প্রাণরসকে অন্তররূদ্ধ তপ্তবাম্পে পরিণত করিয়া য়ুনিভার্সিটি: শেষ ইসটেশনে গিয়া নামিলাম, সেখানে চাকরির বালুমরুতে দীর্ঘ মধ্যাহা জীবিকা-মরীচিকার পিছনে ধূকিতে ধূকিতে চলিলাম, তার পরে সূর্য যখন অস্ত যায় তখন যমরাজের সদর গেটের কাছে গিয়া মাথার বোঝা নামাইয়া দিয়া মনে করিলাম ‘জীবন সার্থক হইল”। জীবনযাত্রার এমন নিরাপদ এবং শান্তিময় আদর্শ অন্য কোথাও নাই। এই আদর্শ আমাদের দেশে যদি চিরদিন টেকা সম্ভবপর হইত। তাহা হইলে কোনো কথা বলিতাম না।