পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\S}\Sჭ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বাংলা যার ভাষা সেই আমার তৃষিত মাতৃভূমির হয়ে বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চাতকের মতো উৎকণ্ঠিত বেদনায় আবেদন জানাচ্ছি ; তোমার অভ্ৰভেদী শিখরচুড়া বেষ্টন করে পুঞ্জ পুঞ্জ অপমান দূর হােক, যুগশিক্ষার উদবেল ধারা বাঙালিচিত্তের শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়ে বয়ে যাক, দুই কূল জণ্ডিক পূর্ণ চেতনায়, ঘাটে ঘাটে উঠুক। আনন্দধ্বনি। : ভাষণ : ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ ৷৷ শিক্ষা ও সংস্কৃতি । শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে...আলোচনা করব স্থির করেছিলুম, ইতিমধ্যে কোনো-একটি আমেরিকান কাগজে এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পড়লুম ; পড়ে খুশি হয়েছি। আমার মতটি এই লেখায় ঠিকমতো ব্যক্ত হয়েছে। হবার প্রধান কারণ এই, আমেরিকা দীর্ঘকাল থেকে বৈষয়িক সিদ্ধির নেশায় মেতে ছিল। সেই সিদ্ধির আয়তন ছিল অতি স্থূল, তার লোভ ছিল প্ৰকাণ্ড মাপের। এর ব্যাপ্তি ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। তার ফলে সামাজিক মানুষের যে পূর্ণতা সেটা চাপা পড়ে গিয়ে বৈষয়িক মানুষের কৃতিত্ব সব ছাড়িয়ে উঠেছিল। আজ হঠাৎ সেই অতিকায় বৈষয়িক মানুষটি আপন সিদ্ধিপথের মাঝখানে অনেক দামের জটিল যানবাহনের চাকা ভেঙে, কল বিগড়িয়ে, ধুলায় কাত হয়ে পড়েছে। এখন তার ভাবনার কথা এই যে, সব ভাঙাচোরা বাদ দিয়ে মানুষটার বাকি রইল কী। এত কাল ধরে যা-কিছু সে গড়ে তুলছিল, যা-কিছুকে সে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছিল, তার প্রায় সমস্তই বাইরের। বাইরে যখন ভাঙন ধরে তখন ভিতরটাতে যদি দেখে সমস্ত কঁােক তা হলে সাস্তুনা পাবে কী নিয়ে? আসবাবগুলো গেল, কিন্তু মানুষটা কোথায়? সে এই বলে শোক করছে যে, সে আজ ভিক্ষুক ; বলতে পারছে না। আমার অন্তরে সম্পদ আছে। আজ তার মূল্য নেই ; কেননা সে আপনাকে হাটের মানুষ করে তুলেছিল, সেই হাট গেছে ভেঙে ৷ ] একদিন ভারতবর্ষে যখন তার নিজের সংস্কৃতি ছিল পরিপূর্ণ তখন ধনলাঘবকে সে ভয় করত। না, লজ্জা করত না ; কেননা তার প্রধান লক্ষ্য ছিল অন্তরের দিকে। সেই লক্ষ্য নির্ণয় করা, অভ্যাস করা, তার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করা শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ। অবশ্য, তারই এক সীমানায় বৈষয়িক শিক্ষাকে স্থান দেওয়া চাই, কেননা মানুষের সত্তা ব্যবহারিক-পারমার্থিককে মিলিয়ে। সংস্কৃতির অভাব আছে অথচ দক্ষতা পুরোমাত্রায়, এমন খোঁড়া মানুষ চলেছিল বাইসিক্ল চড়ে। ভাবে নি কোনো চিন্তার কারণ আছে, এমন সময় বাইসিকল পড়ল ভেঙে। তখন বুঝল, বহুমূল্য যন্ত্রটার চেয়ে বিনা মূল্যের পায়ের দাম বেশি। যে মানুষ উপকরণ নিয়ে বড়াই করে সে জানে না। আসলে সে কতই গরিব । বইসিকলের আদর কমাতে চাই নে, কিন্তু দুটাে সজীব পায়ের আদর তার চেয়ে বেশি। যে শিক্ষায় এই সজীব পায়ের জীবনীশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে তাকেই ধন্য বলি, যে শিক্ষায় প্রধানত আসবাবের প্রতিই মানুষকে নির্ভরশীল ক’রে তোলে তাকে মুঢ়তার বাহন বলব। যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করি তখন এই লক্ষাটাই আমার মনে প্রবল ছিল। হয়ে কী ক’রে বাহিরে কর্মকুশলতা ও অন্তরে আপনি সম্মানবােধ রক্ষা করা যায়। এইটেই শিক্ষাসাধ্য। তখন আশ্রমে গরিকের মতোই ছিল জীবনযাত্রা, সেই গরিবিয়ানাকে লজ্জা করাই