পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\Sბ\ტა রবীন্দ্র-রচনাবলী একদিন নিজের স্বভাবেই ইহার পরিচয় পাইয়াছিলাম, সে কথাটা এইখানেই কবুল করি। পূর্বেই তো বলিয়াছি যে-ভাষা পুথিতে পড়িয়াছি সেই ভাষাতেই চিরদিন পুথি লিখিয়া হাত পাকাইলাম, এ লইয়া এপক্ষে বা ওপক্ষে কোনােপ্রকার মত গড়িয়া তুলিবার সময় পাই নাই। কিন্তু ফাকায় থাকিয়া অনেকদিন হইতেই বাংলা সাহিত্যের ভাষা সম্বন্ধে একটা মত খাড়া করিয়াছেন। বহুকাল পূর্বে তীর এই মত যখন আমার কানে উঠিয়াছিল আমার একটুও ভালো লাগে নাই। এমন-কি রাগ করিয়াছিলাম। নূতন মতকে পুরাতন সংস্কার অহংকার বলিয়া তাড়া করিয়া আসে, কিন্তু অহংকার যে পুরাতন সংস্কারের পক্ষেই প্রবল এ কথা বুঝিতে সময় লাগে। অতএব, প্রাকৃত ংলাকে পুথির পঙক্তিতে তুলিয়া লইবার বিরুদ্ধে আজকের দিনে যে-সব যুক্তি শোনা যাইতেছে সেগুলো আমিও একদিন আবৃত্তি করিয়াছি। ! এক জায়গায় আমার মন অপেক্ষাকৃত সংস্কার-মুক্ত। পদ্য রচনায় আমি প্রচলিত আইন-কানুন কোনোদিন মানি নাই। জানিতাম কবিতায় ভাষা ও ছন্দের একটা বঁধন আছে বটে, কিন্তু সে বঁাধন নূপুরের মতো, তাহা বেড়ির মতো নয়। এইজন্য কবিতার বাহিরের শাসনকে উপেক্ষা করিতে ‘ক্ষণিকায় আমি প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত বাংলা ভাষা ও প্রাকৃত বাংলার ছন্দ ব্যবহার করিয়াছিলাম। তখন সেই ভাষার শক্তি, বেগ ও সৌন্দৰ্য প্রথম স্পষ্ট করিয়া বুঝি। দেখিলাম। এ ভাষা পাড়াগায়ের টাটু ঘোড়ার মতো কেবলমাত্র গ্রাম্য-ভাবের বাহন নয়, ইহার গতিশক্তি ও বাহিনশক্তি কৃত্রিম পুঁথির ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। বলা বাহুল্য ‘ক্ষণিকায় আমি কোনো পাকা মত খাড়া করিয়া লিখি নাই, লেখার পরেও একটা মত যে দৃঢ় করিয়া চলিতেছি তাহা বলিতে পারি না। আমার ভাষা রাজাসন এবং রাখালী, মথুরা এবং বৃন্দাবন, কোনোটার উপরেই আপন দাবি সম্পূর্ণ ছাড়ে নাই। কিন্তু কোন দিকে তার অভ্যাসের টান এবং কোন দিকে অনুরাগের, সে বিচার পরে হইবে এবং পরে করিবে। এইখানে বলা আবশ্যক চিঠিপত্রে আমি চিরদিন কথ্য ভাষা ব্যবহার করিয়াছি। আমার সতেরো বছর বয়সে লিখিত "য়ুরোপ যাত্রীর পত্রে' এই ভাষা প্রয়োগের প্রমাণ আছে। তা ছাড়া বক্তৃতাসভায় আমি চিরদিন প্রাকৃত বাংলা ব্যবহার করি, শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে তাহার উদাহরণ যাই হােক এ সম্বন্ধে আমার মনে যে তর্ক আছে সে এই— বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে, এবং তার সূত্ৰধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাদের ভাসুর-ভাদ্রবউয়ের সম্বন্ধ। তঁরা এ ভাষার কখনো মুখদর্শন করেন নাই। এই সজীব ভাষ্য তঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেইজন্য ইহাকে তঁরা আমল দিলেন না। তঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বািসন দিয়া যজ্ঞকর্তার ফরমাসে তারা সোনার সীতা যদি স্বভাবের তাগিদে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হইত, তবে এমন গড়াপেটা ভাষা দিয়া তার আরম্ভ হইত না। তবে গোড়ায় তাহা কঁচা থাকিত এবং ক্রমে ক্ৰমে পাকা নিয়মে তার বাঁধন আঁটি হইয়া উঠিত। প্রাকৃত বাংলা বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে প্রয়োজনমতো সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার হইতে আপন অভাব দূর করিয়া লইত। . ' '