পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব 8 S6 আপনার প্রন্থের নামটি’ যত ভয়ানক বস্তুটি তত ভয়ংকর নয়। কিন্তু তবুও বােপদেব লোহারাম যখন ভ্ৰকুটি করেন তখন হৎকম্প হয় না বাংলালেখকদের মধ্যে এমন কয়জন আছে, তবে কি আমার অপরাধের অন্ত নাই এখন আর লজ্জা করিয়া কী হইবে। " ংলা ভাষার মুশকিল হইয়াছে এই যে ইহাকে এক ভাষা বলিয়া গণ্য করিলে চলে না। বাংলা শিখিতে হইলে সংস্কৃতও শিখিতে হইবে। সেও সকলে পারিয়া উঠে না-মাতৃভাষা বলিয়া নিৰ্ভয়ে আবদার করিতে যায়, শেষকালে মাতামহীর কোপে পড়িয়া বিপন্ন হয়। মাতা ও মাতামহীর চাল স্বতন্ত্র, এক ব্যাকরণে তঁহাদের কুলায় না। এ অবস্থায় হতভাগ্য বাঙালির চলে কি করিয়া, পরম পণ্ডিত না হইলে সে কি নিজের ভাষা ব্যবহার করিতেও পরিবে না। আর-একদিকে দেখুন। বাঙালির ছেলেকে ছেলেবেলা হইতে ইংরেজি শিখিতেই হইবে। অল্প বয়স হইতে যে পরিমাণ বাংলার চর্চা করিলে সে অনায়াসে বাংলায় আপনার ভাব প্রকাশ করিতে পারিত সে তাহার ঘটিয়া উঠে না। ইহাদের যদি বলা যায় তোমরা বাংলা লিখিতে পরিবে না। তবে কয়জন লোকে বাংলা লিখিবে। কারণ, ইহাও সত্য, এখন আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া অন্য শিক্ষা নাই। সেই শিক্ষিত ব্যক্তির পনেরো-আনা যদি বাংলা লিখিতে না পায়। তবে সম্ভবত ভাষা অত্যন্ত বিশুদ্ধ হইবে কিন্তু সে ভাষার প্রয়োজন থাকিবে না। আধুনিক বাংলা সাহিত্যটাকে গড়িয়া তুলিতেছেন যাহারা, তঁহারা ইংরেজিনবিশ। তঁহাদের পেটে কথা জমিয়াছে বলিয়াই তাহারা লিখিয়াছেন। যাহারা সংস্কৃত ব্যাকরণে পণ্ডিত তাহারা বাংলা ভাষার প্রতি মন দেন নাই সে তো জানা কথা। এখনো বাংলা যাহারা লেখেন। তঁহাদের অতি অল্প সংখ্যাই সংস্কৃত ভালো করিয়া জানেন। যাহারা ইংরাজি জানেন না কেবল মাত্র সংস্কৃত জানেন তাহারা কেহ কেহ বাংলা লেখেন, তাহারা ভাষা বিশুদ্ধ কিন্তু বাজারে তাহা চলে না। অনেক লেখক লিখিতে লিখিতে ক্ৰমে সংস্কৃত শিখিতে থাকেন- কালীপ্রসন্ন ঘোষ মহাশয় যখন প্রথম লিখিতে আরম্ভ করেন তখন তিনি সংস্কৃতে পাকা ছিলেন না, তাহার লেখায় তাহার প্রমাণ আছে কাজেই সাহিতো এমন অনেক জিনিস জমিয়া উঠিতে থাকে- ব্যাকরণের সূত্র যাহার মধ্যে প্ৰবেশ করিবার পথ পায় না। 势 ... . ংলা লেখকের পুরস্কার যে খুব বেশি তাহা নয়, ইহার উপরে তাহার লেখনী চালনার পথ যদি অত্যন্ত দুৰ্গম করা হয় তবে সীতা পাইবার আসা পরিত্যাগ করিয়াও লোককে ধনুক ভাঙিতে ডাকা হয়। তাই বলিয়াই যে ভাষার উপরে যে যেমন খুশি দৌরাত্মা করিবে তাহাও সহ্য করা যায় না। অতএব একটা রফি নিস্পত্তির পথ ধরিতেই হয়। কিন্তু সে পথটা কেহ বাধিয়া দিতে পারে না-নদীর মতো ভাষা। আপনিই স্বল্পতম বাধার পথ হাতড়াইয়া চলে। আপনি সে কথাও বলিয়াছেন। আপনার বই পড়িয়াই আমার মনে বিশেষ করিয়া এই চিন্তার উদয় হইল- বাংলা সাহিত্যের খেয়া পার হইতে হইলে তিন ঘটে তাহার মাশুল দিতে হয়, বাংলা ইংরেজি এবং ংস্কৃত। বাংলা ও ইংরেজির পারানির কড়ি কোনো প্রকারে সংগ্ৰহ হয়, সংস্কৃতের বেলায় ঠেকে, কেননা তাহার জন্য দূরে ঘোরাঘুরি করিতে হয়—সকলের সামর্থ্যে ও সময়ে কুলায় না ১ ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত “ব্যাকরণ বিভীষিকা’ গ্ৰন্থ