পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব 863 পক্ষী অথচ পড়ি পাখি, লিখি বিদ্যুলি পড়ি বিজুলি, লিখি শ্রবণিয়ছিলাম পড়ি শুনিয়াছিলাম, কিন্তু আমাদের দেশের নজির উলটা। প্রাকৃত ও পালি, বানানের দ্বারা নিৰ্ভয়ে নিজের শব্দেরই পুরাতত্ত্বের বোঝা মিউজিয়ম বহন করিতে পারে, হাটে-বাজারে তাহাকে যথাসাধ্য বর্জন করিতে হয়। এইজন্যই লিখিবার বেলায় আমরা নুন’ লিখি, পণ্ডিতই জানেন উহার মূল শব্দে একটা মূর্ধন্য ণ ছিল। এইজন্যই লিখিবার বেলা গাম্ভলা না লিখিয়া আমরা গামলা লিখি, পণ্ডিতই অনুমান করেন উহার মূল শব্দ ছিল কুস্ত। আমরা লিখিয়া থাকি আঁতুর ঘর, তাহাতে আমাদের কাজের কোনো ক্ষতি হয় না- পাণ্ডিত্যের দোহাই মানিয়া যদি অন্ত্র-ত্রুটি ঘর বানান করিয়া আঁতুর ঘর পড়িতে হইত। তবে যে-শব্দ প্রাচীনের গর্ভ হইতে বহির হইয়াছে তাহাকে পুনশ্চ গৰ্ভবেদনা সহিতে হইত। প্রাচীন বাঙালি, বানান সম্বন্ধে নিৰ্ভীক ছিলেন, পুরানো বাংলা পুথি দেখিলেই তাহা বুঝা যায়। আমরা হঠাৎ ভাষার উপর পুরাতত্ত্বের শাসন চালাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। এই শাসন ম্যালেরিয়া প্রভৃতি অন্যান্য নানা উপসর্গের মতো চিরদিনের মতো বাঙালির ছেলের আয়ুক্ষয় করিতে থাকিবে। কোনো অভ্যাসকে একবার পুরানো হইতে দিলেই তাহা স্বভাবের চেয়েও প্রবল হইয়া ওঠে। অতএব এখনো সময় থাকিতে সাবধান হওয়া উচিত। সংস্কৃত শব্দ বাংলায় অনেক আছে। এবং চিরদিন থাকিবেই— সেখানে সংস্কৃতের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের মানিতেই হইবে।— কিন্তু যেখানে বাংলা শব্দ বাংলাই সেখানেও সংস্কৃতের শাসন যদি টানিয়া আনি, তবে রাস্তায় যে পুলিস আছে ঘরের ব্যবস্থার জন্যও তাঁহার গুতা ডাকিয়া আনার মতো হয়। সংস্কৃতে কৰ্ণ লিখিবার বেলা মূর্ধন্য ণ ব্যবহার করিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু কান লিখিবার বেলাও যদি সংস্কৃত অভিধানের কানমলা খাইতে হয় তবে এ পীড়ন সহিবে কেন ? ) যে সময়ে ফোর্ট উইলিয়াম হইতে বাংলা দেশ শাসন শুরু হইয়াছিল। সেই সময়ে বাংলা ভাষার শাসন সেই কেল্লা হইতেই আরম্ভ হয়। তখন পণ্ডিতে-ফৌজে মিলিয়া বাংলার বানান বধিয়া দিয়াছিল। আমাদের ভাষায় সেই ফোর্ট উইলিয়ামের বিভীষিকা এখনো তাই গৌড়সন্তানের চোখের জলকে অক্ষয় করিয়া রাখিয়াছে। সেইজন্য যেখানে আমাদের পিতামহেরা ‘সোনা” লিখিয়া সুখী ছিলেন সেখানে আমরা সোণা লেখাইবার জন্য বেত ধরিয়া বসিয়া আছি। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের বর্তমান দণ্ডধারীদের জিজ্ঞাসা করি-সংস্কৃত নিয়মমতেও কি সোণা কাণ বিশুদ্ধ বানান ? বৰ্ণন হইতে যদি বানান হয়, তবে কৰ্ণ হইতে কি কাণ হইবে ? রেফ লোপ হইলেও কি মূর্ধন্য ণ তার সঙিন খাড়া করিয়া থাকিতে পারে? - , Kv y SSS বাংলার বানান-সমস্যা বিদেশী রাজার হুকুমে পণ্ডিতেরা মিলে পুথিতে আধুনিক গদ্য-বাংলা পাকা করে গড়েছে। অথচ গদ্যভাষা যে-সর্বসাধারণের ভাষা, তার মধ্যে অপণ্ডিতের ভাগই বেশি। পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষার ছাঁচে ঢালাই করলেন সেটা হল অত্যন্ত আড়ষ্ট। বিশুদ্ধভাবে সমস্ত তার বাধাবাঁধি- সেই বঁধন তার নিজের নিয়মসংগত নয়- তার ষত্ব ণত্ব সমস্তই সংস্কৃত ভাষার