পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব 88. লেখকের ভাষায় যদি সেটা স্বতই প্রকাশিত না হয়ে থাকে তা হলে একটা চিহ্ন ভাড়া করে এনে দৈন্য ঢাকবে না। ও যেন আগ্ৰীয়ের মৃত্যুতে পেশাদার শোকওয়ালির বুক-চাপড়নি। অহাে, হিমালয়ের কী অপূর্ব গাভীর্য’। এর পরে কি ঐ ফেঁটা-সওয়ারি দাঁড়িটার আকাশে তর্জনীনির্দেশের দরকার আছে- (রোসো, প্রশ্নচিহ্নটা এখানে না দিলে কি তোমার ধাঁধা লাগবে ?)। কে, কি, কেন, কার, কিসে, কিসের, কত প্রভৃতি এক ঝাক অব্যয় শব্দ তো আছেই। তবে চিহ্নের খোশামুদি করা কেন। ‘তুমি তো আচ্ছা লোক’ এখানে 'তো'-ইঙ্গিতের পিছনে আরো-একটা চিহ্নের ধাক্কা দিয়ে পাঠককে ডবল চমক খাওয়ানোর দরকার আছে কি। পাঠক কি আফিমখোর। ‘রোজ রোজ যে দেরি করে আসে” এই বাক্যবিন্যাসেই কি নালিশের যথেষ্ট জোর পৌছল না। যদি মনে কর অর্থটা স্পষ্ট হল না তা হলে শব্দযোগে অভাব পূরণ করলে ভাষাকে বৃথা ঋণী করা হয় না- যথা, ‘রোজ রোজ বড়ো-যে দেরি করে আস'। মুশকিল। এই যে, পাঠককে এমনি চিহ্ন-মেীতাতে পেয়ে বসেছে, ওগুলো না দেখলে তার চোখের তার থাকে না। লঙ্কাবাটা দিয়ে তরকারি তো তৈরি হয়েছেই। কিন্তু সেইসঙ্গে একটা আস্ত লঙ্কা দৃশ্যমান না হলে চােখের ঝাল জিভের ঝালে মিলনাভাবে ঝাঝটা ফিকে বোধ হয়। ছেদ চিহ্নগুলো আর-এক জাতের। অর্থাৎ যতি-সংকেতে পূর্বে ছিল দণ্ডহাতে একাধিপত্যগর্বিত সিধে দাঁড়ি- কখনো-বা একলা কখনো দোকলা। যেন শিবের তপোবনদ্বারে নন্দীর তর্জনী। এখন তাঁর সঙ্গে জুটে গেছে বঁকা বঁকা ক্ষুদে ক্ষুদে অনুচর। কুকুরবিহীন সংকুচিত লেজের মতো। যখন ছিল না। তখন পাঠকের আন্দাজ ছিল পাকা, বাক্যপথে কোথায় কোথায় বাক তা সহজেই বুঝে নিত। এখন কুঁড়েমির তাগিদে বুঝেও বোঝে না। সংস্কৃত নাটকে দেখেছি রাজার আগে আগে প্রতিহারী চলে- চিরাভ্যস্ত আন্তঃপুরের পথেও ক্ষণে ক্ষণে হেঁকে ওঠে, “এই দিকে” ‘এই দিকে'। কমা সেমিকোলনগুলো অনেকটা তাই। একদিন চিহ্নপ্রয়োগে মিতবায়ের বুদ্ধি যখন আমাকে পেয়ে বসেছিল তখনই আমার কাব্যের পুনঃসংস্করণকালে বিস্ময়সংকেত ও প্রশ্নসংকেত লোপ করতে বসেছিলুম। প্রৌঢ় যতিচিহ্ন সেমিকোলনকে জবাব দিতে কুষ্ঠিত হই নি! কিশোর কমা-কে ক্ষমা করেছিলুম, কারণ, নেহাত খিড়কির দরজায় দাঁড়ির জমাদারী মানানসই হয় না। লেখায় দুই জাতের যতিই যথেষ্ট, একটা বড়ো একটা ছোটাে। সূক্ষ্ম বিচার করে আরো-একটা যদি আনো তা হলে অতি সূক্ষ্ম বিচার করে ভাগ আরো অনেক বাড়বে না কেন। । চিহ্নের উপর বেশি নির্ভর যদি না করি তবে ভাষা সম্বন্ধে অনেকটা সতর্ক হতে হয়। মনে করো কথাটা এই ; তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ।” এখানে বাবুয়ানার উপর ঠেস দিলে কথাটা প্রশ্নসূচক হয়- ওটা একটা ভাঙা প্রশ্ন-পুরিয়ে দিলে দাঁড়ায় এই, “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ। তার মানেটা কী বলে দেখি।' 'যে’ অব্যয় পদের পরে ঠেস দিলে বিস্ময় প্রকাশ পায়। ‘তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ'। প্রথমটাতে প্রশ্ন এবং দ্বিতীয়টাতে বিস্ময়চিহ্ন দিয়ে কাজ সারা যায়। কিন্তু যদি চিহ্ন দুটাে না থাকে তা হলে ভাষাটাকে নিঃসন্দিগ্ধ করে তুলতে হয়। তা হলে বিস্ময়সূচক বাক্যটাকে শুধরিয়ে বলতে হয়-“যে বাবুয়ানা তুমি শুরু করেছ? 1 : এইখানে আর-একটা আলোচ্য কথা আছে। প্রশ্নসূচক অব্যয় 'কি' এবং প্রশ্নবাচক সর্বনাম কি? উভয়ের কি এক বানান থাকা উচিত। আমার মতে বানানের ভেদ থাকা আবশ্যক। একটাতে ইশ্ব ই ও অন্যটাতে দীর্ঘ ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝবার সুবিধা হয়। ‘তুমি কি রাধছ’ 'ट्रशिी ती রাধছা-বলা বাহুল্য এ দুটাে বাক্যের ব্যঞ্জনা স্বতন্ত্র। তুমি রাধছ কিনা, এবং