পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা (? RS কহিতে হইলে কণ্ঠস্থিত মাংসপেশীর বিশেষ পরিশ্রমের আবশ্যক করে। মনোভাবের বিশেষ উত্তেজনা হইলেই তবে আমরা আমাদের স্বাভাবিক মাঝামাঝি সুর ছাড়াইয়া উঠি অথবা নামি। অতএব দেখা যাইতেছে বেগবান মনোবৃত্তির প্রভাবে আমরা আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তার সুরের বাহিরে যাই। সচরাচর যখন শান্তভাবে কথাবার্তা কহিয়া থাকি তখন আমাদের কথার স্বর অনেকটা একঘেয়ে হয়। সুরের উঁচু-নীচু খেলায় না। মনোবৃত্তির তীব্রতা যতই বাড়ে, ততই আমাদের কথায় সুরের উচ্চ-নীচু খেলিতে থাকে। আমাদের গলা খুব নীচু হইতে খুব উচু পর্যন্ত উঠানামা করিতে থাকে। কণ্ঠের সাহায্য ব্যতীত ইহার দৃষ্টান্ত দেওয়া দুরূহ। পাঠকেরা একবার কল্পনা করিয়া দেখুন আমরা যখন কাহারো প্রতি রাগ করিয়া বলি, “এ তোমার কী রকম স্বভাব ?” ‘এ’ শব্দটা কত উচু সুরে ধরি ও স্বভাব' শব্দটায় কতটা নীচু সুরে নামিয়া আসি ; ঠিক এক গ্রামের বৈলক্ষণ্য হয়। যাহা হউক, দেখা যাইতেছে, সচরাচর কথাবার্তার সহিত মনোবৃত্তির উত্তেজিত অবস্থার কথাবার্তার ধারা স্বতন্ত্র। পাঠকেরা অবধান করিয়া দেখিবেন যে, উত্তেজিত অবস্থার কথাবার্তার যে-সকল লক্ষণ, সংগীতেরও তাঁহাই লক্ষণ। সুখ দুঃখ প্রভৃতির উত্তেজনায় আমাদের কণ্ঠস্বরে যে-সকল পরিবর্তন হয়, সংগীতে তাহারই চূড়ান্ত হয় মাত্র। পূর্বে উক্ত হইয়াছে যে, উত্তেজিত মনোবৃত্তির অবস্থায় আমাদের কথোপকথনে স্বর উচ্চ হয়; স্বরে সুরের আভাস থাকে ; সচরাচরের অপেক্ষা স্বরের সুর উচু অথবা নীচু হইয়া থাকে, এবং স্বরে সুরের উচু-নীচু ক্রমাগত খেলিতে থাকে। গানের স্বরও উচ্চ, গানের সমস্তই সুর ; গানের সুর সচরাচর কথোপকথনের সুর হইতে অনেকটা উচু অথবা নীচু হইয়া থাকে, এবং গানের সুরে উচু-নীচু ক্রমাগত খেলাইতে থাকে। অতএব দেখা যাইতেছে যে, উত্তেজিত মনোবৃত্তির সুর সংগীতে যথাসম্ভব পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। তীব্ৰ সুখ দুঃখ কণ্ঠে প্রকাশের যে লক্ষণ সংগীতেরও সেই লক্ষণ। আমাদের মনোভাব গাঢ়তম তীব্রতম রূপে প্রকাশ করিবার উপায়স্বরূপে সংগীতের স্বাভাবিক উৎপওি। যে উপায়ে ভােব সর্বোৎকৃষ্টরূপে প্ৰকাশ করি, সেই উপায়েই আমরা ভাব সর্বোৎকৃষ্টরূপে অন্যের মনে নিবিষ্ট করিয়া দিতে পারি। অতএব সংগীত নিজের উত্তেজনা প্রকাশের উপায় ও পরকে উত্তেজিত করিবার উপায়। সংগীতের উপযোগিতা সম্বন্ধে স্পেন্সর বলিতেছেন- আপাতত মনে হয় যেন সংগীত শুনিয়া যে অব্যবহিত সুখ হয়, তাহাই সাধন করা সংগীতের কার্য। কিন্তু সচরাচর দেখা যায়, যাহাতে আমরা অব্যবহিত সুখ পাই তাহাই তাহার চরম ফল নহে। আহার করিলে ক্ষুধা নিবৃত্তির সুখ হয়, কিন্তু তাহার চরম ফল শরীর পোষণ। মাতা স্নেহের বশবর্তী হইয়া আত্মসুখ-সাধনের জন্য যাহা করেন তাহাতে সন্তানের মঙ্গল সাধন হয় ; যশের সুখ পাইবার জন্য আমরা যাহা করি তাহাতে সমাজের নানা কাৰ্য সম্পন্ন হয় ; ইত্যাদি। সংগীতে কি কেবল আমোদ মাত্রই হয় ? অলক্ষিত কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হয় না ? সকল প্রকার কথোপকথনে দুইটি উপকরণ বিদ্যমান আছে। কথা, ও যে ধরনে সেই কথা উচ্চারিত হয়, কথা ভাবের চিহ্ন (signs of ideas), আর ধরন অনুভবের s6< (signs of feeling)। কতকগুলি বিশেষ শব্দ আমাদের ভাবকে বাহিরে প্রকাশ করে, এবং সেই ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ে যে-সুখ বা দুঃখ উদয় হয়, সুরে তাঁহাই প্রকাশ করে। “ধরন” বলিতে যদি সুরের বাঁকচাের উঁচু-নীচু সমস্তই বুঝায়। তবে বলা যায় যে, বুদ্ধি যাহা-কিছু কথায় বলে, হৃদয় “ধরন” দিয়া তাহারই টীকা করে। কথাগুলি একটা প্ৰস্তাব মাত্র, আর বলিবার ধরন তাহার টীকা 98ܘlܛ ܠ