পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q○ミ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রঞ্জক আকৃতি নির্মাণ করা। কেহই অস্বীকার করিবেন না যে, প্রথমটিই উচ্চতর শ্রেণীর চিত্রবিদ্যা। আমাদের দেশে শালের উপরে, নানাবিধ কাপড়ের পাড়ে, রেখাবিন্যাস ও বর্ণবিন্যাস দ্বারা বিবিধ নয়ন-রঞ্জক আকৃতিসকল চিত্রিত হয়, কিন্তু শুদ্ধ তাঁহাতেই আমরা ইটালীয়দের ন্যায় চিত্ৰ-শিল্পী বলিয়া বিখ্যাত হইব না। আমাদের সংগীতও সেইরূপ সুরবিন্যাস মাত্র, যতক্ষণ আমরা তাহার মধ্যে অনুভব না আনিতে পারিব, ততক্ষণে আমরা উচ্চশ্রেণীর সংগীতবিৎ বলিয়া গর্ব করিতে পারিব না। অতএব স্বীকার করা যাক রাগরাগিণীর শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য ভাব প্রকাশ করা। কিন্তু এখন তাহা কী হইয়া দাঁড়াইয়াছে? এখন রাগরাগিণীই উদ্দেশা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে রাগরাগিণীর হস্তে ভাবটিকে সমর্পণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সে রাগরাগিণী আজ বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক ভাবটিকে হতা করিয়া স্বয়ং সিংহাসন দখল করিয়া বসিয়া আছেন। আজ গান শুনিলেই সকলে দেখিতে চান, জয়জয়ন্তী, বেহাগ বা কানেড়া বজায় আছে কি না, আরো মহাশয়, জয়জয়ন্তীর কাছে আমরা এমন কী ঋণে বদ্ধ, যে, তাহার নিকটে আমনতরো অন্ধ দাসবৃত্তি করিতে হইবে ? যদি স্থল বিশেষে মধ্যমের স্থানে পঞ্চম দিলে ভালো শুনায় কিংবা মন্দ শুনায় না, আর তাহাতে বর্ণনীয় ভাবের সহায়তা করে, তবে জয়জয়ন্তী বাচুন বা মরুন, আমি পঞ্চমকেই বাহাল রাখিব না কেন— আমি জয়জয়ন্তীর কাছে এমন কী ঘুষ খাইয়াছি যে তাহার এত গোলামি করিতে হইবে ? আজকাল ওস্তাদবর্গ যখন ভীষণ মুখশ্ৰী বিকাশ করিয়া গলদঘর্ম হইয়া গান শুরু করেন, তখন সর্ব প্রথমেই ভাবের গলাটা এমন করিয়া টিপিয়া ধরেন, ও ভাব বেচারীকে এমন করিয়া ত্ৰাহি ত্ৰাহি আর্তনাদ ছাড়ান যে, সহৃদয় শ্রোতা মাত্রেরই বড়ো কষ্ট বোধ হয়। বৈয়াকরণে ও কবিতে যে প্রভেদ, উপরি-উক্ত ওস্তাদের সহিত আর-একজন ভাবুক গায়কের সেই প্রভেদ। কোন কোন রাগরাগিণীতে কী কী সুর লাগে না-লাগে তাহা তো মান্ধাতার আমলে স্থির হইয়া গিয়াছে, তাহা লইয়া আর অধিক পরিশ্রম করিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না, এখন সংগীতবেত্তারা যদি বিশেষ আরম্ভ করেন, তবেই সংগীতের যথার্থ উপকার করেন। আমাদের রাগরাগিণীর মধ্যে একটা ভাব আছে, তাহ যাইবে কোথা বলো ? কেবল ওস্তাদ বর্গেরা তাহদের অত্যন্ত উৎপীড়ন করিয়া থাকেন, তাহাদের প্রতি কিছুমাত্ৰ মনোযোগ দেন না, এমন-কি তাহারা তঁহাদের চোখে পড়েই না। সংগীতবেত্তারা সেই ভাবের প্রতি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করুন। কেন বিশেষ বিশেষ একএক-রাগিণীতে বিশেষ বিশেষ এক-একটা ভাবের উৎপত্তি হয় তাহার কারণ বাহির করুন। এই মনে করুন, পূরবীতেই বা কেন সন্ধ্যাকােল মনে আসে আর ভৈরোতেই বা কেন প্রভাত মনে আসে? পূরবীতেও কোমল সুরের বাহুল্য, আর ভৈরোতেও কোমল সুরের বাহুল্য, তবে উভয়েতে বিভিন্ন ফল উৎপন্ন করে কেন ? তাহা কি কেবলমাত্র প্রাচীন সংস্কার হইতে হয় ? উপস্থিতিমতো এ বিষয়ে একটা মত দেওয়া আমার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। এই পর্যন্ত বলিতে পারি ভৈরো শুনিবামাত্র আমার মনে প্ৰভাতের ভাব আসে এবং পূরবী, গৌরী প্রভৃতি রাগিণী শুনিবা মাত্ৰ মনের মধ্যে সন্ধ্যার মূর্তি জাজ্বল্যমান হইয়া উঠে। তাহার কতটা পূর্বসংস্কারবশত কতটা অন্য কারণবশত বলা, বিচারসাধ্য। উষা আপনার গীতনিদ্র জীবনের পরিপূর্ণতা লইয়া অগাধ নিস্তব্ধ, সে জীবনের এখনো ব্যয় হয় নাই ক্ষয় হয় নাই। কার্য আরম্ভ হয় নাই- আর সন্ধ্যা পরিণামগাম্ভীৰ্য ঔদাস্যে বৈরাগ্যে শ্ৰান্তিভারে আসন্ন। তিমির রজনীর আগমন অপেক্ষায় নিস্তব্ধভৈঁরো এবং পূরবীতে প্ৰভাত ও সন্ধ্যার এই ঐক্য অথচ অনৈক্য আমার মনে উদয় করিয়া দেয়।