পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

न९ोद्धष्ठिा স্বতন্ত্র হইয়া নক্ষত্ৰলোকের বিরাট ঐক্যকে যখন বিচিত্র করিরা তোলে, তখন তাহতেই সৃষ্টির পরিণতি । বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণবকাব্যেই সেই বৈচিত্ৰ্যচেষ্টা প্রথম দেখিতে পাই। সাহিত্যে এইরূপ স্বাতন্ত্র্যের উদ্যমকেই ইংরেজিতে রোম্যান্টিক মুভমেন্ট বলে। এই স্বাতন্ত্রচেষ্টা কেবল কাব্যছন্দের মধ্যে নয়, সংগীতেও দেখা দিল। সেই উদ্যামের মুখে কালোয়াতি গান আর টিকিল না। তখন সংগীত এমন-সকল সুর খুজিতে লাগিল যাহা হািদয়াবেগের বিশেষত্বগুলিকে প্রকাশ করে, রাগরাগিণীর সাধারণ রূপগুলিকে নয়। তাই সেদিন বৈষ্ণবধর্ম শান্ত্রিক পণ্ডিতের কাছে যেমন অবজ্ঞা পাইয়াছিল, ওস্তাদির কাছে কীর্তন গানের তেমনই অনাদর ঘটিয়াছে। আজ নূতন যুগের সোনার কাঠি আমাদের অলস মনকে ছুইয়াছে। কেবল ভোগে আর আমাদের তৃপ্তি নাই, আমাদের আত্মপ্রকাশ চাই। সাহিত্যে তার পরিচয় পাইতেছি। আমাদের নূতন-জাগরকে চিত্রকলাও পুরাতন রীতির আবরণ কাটিয়া আত্মপ্রকাশের বৈচিত্র্যের দিকে উদ্যত। অর্থাৎ, স্পষ্টই দেখিতেছি। আমরা পৌরাণিক যুগের বেড়ার বাহিরে আসিলাম। আমাদের সামনে এখন জীবনের বিচিত্র পথ উদঘাটিত। নূতন নূতন উদভাবনের মুখে আমরা চলিব! আমাদের সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন চিত্রকলা সবই আজ অচলতার বাঁধন হইতে ছাড়া পাইয়াছে। এখন আমাদের সংগীতও যদি এই বিশ্বযাত্রার তালে তাল রাখিয়া না চলে। তবে ওর আর উদ্ধার নাই। হয়তো সেও চলিতে শুরু করিয়াছে। কিছুদূর না এগোলে তার হিসাব পাওয়া যাইবে না। এক দিক হইতে দেখিলে মনে হয় যেন গানের আদর দেশ হইতে চলিয়া গেছে। ছেলেবেলায় কলিকাতায় গাঁহিয়ে-বাজিয়ের ভিড় দেখিয়াছি ; এখন একটি খুজিয়া মেলা ভার, ওস্তাদ যদি-বা জোটে শ্রোতা জোটানো আরো কঠিন। কালোয়াতি বৈঠকে শেষ পর্যন্ত সবল অবস্থায় টিকিতে পারে এমন ধৈর্য ও বীর্য এ কালে দুর্লভ। এটা আক্ষেপের বিষয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মিল না। রাখিতে পারিলে বড়ো বড়ো মজবুত জিনিসও ভাঙিয়া পড়ে। এমন-কি হালকা জিনিস শীঘ্ৰ ভাঙে না, ভাঙিবার বেলায় বড়ো জিনিসই ভাঙে। তাই আমাদের দেশের প্রাচীন স্থাপত্যের পরিচয় ভগ্নাবশেষ। অন্তত তার ধারা আর সচল নাই। অথচ কুঁড়েঘর আগে যেমন করিয়া তৈরি হইত এখনো তেমনি করিয়া হয়। কেননা, প্রাচীন স্থাপত্য যে-সকল রাজা ও ধনীর বিশেষ প্রয়ােজনকে আশ্রয় করিয়ছিল তারাও নাই, সেই অবস্থারও বদল হইয়াছে। কিন্তু দেশের যে জীবনযাত্ৰা কুঁড়েঘরকে অবলম্বন করে তার কোনো বদল হয় নাই। আমাদের সংগীতও রাজসভা সম্রাট্রসভায় পোষ্যপুত্রের মতো আদরে বাড়িতেছিল। সে-সব সভা গেছে, সেই প্রচুর অবকাশও নাই, তাই সংগীতের সেই যত্ন আদর সেই হৃষ্টপুষ্টতা গেছে। কিন্তু গ্রাম্যসংগীত, বাউলের গান, এ-সবের মার নাই। কেননা, ইহারা যে রসে ললিত সেই জীবনের ধারা চিরদিনই চলিতেছে। আসল কথা, প্রাণের সঙ্গে যোগ না থাকিলে বড়ো শিল্পও টিকিতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান কালের জীবন কেবল গ্রাম্য নহে। তার উপরেও আর-একটা বৃহৎ লোকস্তার জমিয়া উঠিতেছে যার সঙ্গে বিশ্বপূথিবীর যোগ ঘটিল। চিরাগত প্রথার খোপখাপের শধ্যে সেই আধুনিক চিত্তকে আর কুলায় না। তাহ নূতন নূতন উপলব্ধির পথ দিয়া চলিতেছে। শীর্টের যে-সকল আদর্শ স্থাবর, তার সঙ্গে এর গতির যোগ রহিল না, বিচ্ছেদ বাড়িতে লাগিল। এখন আমরা দুই যুগের সন্ধিস্থলে। আমাদের জীবনের গতি যে দিকে, জীবনের নীতি সম্পূর্ণ সে "কের মতো হয় নাই। দুটােতে ঠোকাঠুকি চলিতেছে। কিন্তু যেটা সচল তারই জিৎ হইবে।