পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

688 রবীন্দ্র-রচনাবলী হইবে, তাদের সাহস বাড়িবে, নানারকম সংযোগের দ্বারা তাদের মধ্যে নানাপ্রকার শক্তি ও সৌন্দর্য একটা উপমা দিলে কথাটা স্পষ্ট হইবে। আমাদের দেশের বিপুলায়ত পরিবারগুলি আজকাল আর্থিক ও অন্যান্য কারণে ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে। সেই টুকরা পরিবারের মানুষগুলির মধ্যে ব্যক্তিস্বতন্ত্র্য স্বভাবতই বাড়িয়াছে। তবু সেই পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার ভাবটা আমাদের মন হইতে যায় না। এমন-কি, বাহিরের লোকের সঙ্গে ব্যবহারেও এটা ফুটিয়া ওঠে। এইটেই আমাদের বিশেষত্ব। এই বিশেষত্ব লইয়া ঠিকমতো ব্যবহার করিতে পারিলে আমাদের জীবনটা টিকটিকির কাটা লেজের মতো কিংবা কন্সার্টের তারস্বর গৎগুলার মতো নীরস খাপছাড়া হইবে না, তাহা চারি দিকের সঙ্গে সুসংগত হইবে। তাহা নিজের একটি বিশেষ রাসও রাখিবে, অথচ স্বাতন্ত্রের শক্তিও একটা প্রশ্ন এখনো আমাদের মনে রহিয়া গেছে, তার উত্তর দিতে হইবে। য়ুরোপীয় সংগীতে যে হামনি অর্থাৎ স্বরসংগতি আছে, আমাদের সংগীতে তাহা চলিবে কি না। প্রথম ধাক্কাতেই মনে হয়- না, ওটা আমাদের গানে চলিবে না, ওটা যুরোপীয়।” কিন্তু হার্মানি যুরোপীয় সংগীতে ব্যবহার হয় বলিয়াই যদি তাকে একান্তভাবে যুরোপীয় বলিতে হয় তবে এ কথাও বলিতে হয় যে, যে দেহতত্ত্ব অনুসারে য়ুরোপে অস্ত্ৰচিকিৎসা চলে সেটা যুরোপীয়, অতএব বাঙালির দেহে ওটা চালাইতে গেলে ভুল হইবে। হার্মানি যদি দেশবিশেষের সংস্কারগত কৃত্রিম সৃষ্টি হইত। তবে তো কথাই ছিল না। কিন্তু যেহেতু এটা সত্যবস্তু, ইহার সম্বন্ধে দেশকালের নিষেধ নাই। ইহার অভাবে আমাদের সংগীতে যে অসম্পূর্ণতা সেটা যদি অস্বীকার করি, তবে তাহাতে কেবলমাত্র কণ্ঠের জোর বা দম্ভের জোর প্রকাশ পাইবে। তবে কি না ইহাও নিশ্চিত যে, আমাদের গানে হামনি ব্যবহার করিতে হইলে তার ছােদ স্বতন্ত্র হইবে। অন্তত মূল সুরকে সে যদি ঠেলিয়া চলিতে চায়। তবে সেটা তার পক্ষে আম্পর্ধ হইবে। আমাদের দেশে ঐ বড়ো সুরাটা চিরদিন ফাকায় থাকিয়া চারি দিকে খুব করিয়া ডালপালা ভিড় আমাদের ধাতে সয় না। অতএব আমাদের গানের পিছনে যদি স্বরানুচর নিযুক্ত থাকে, তবে দেখিতে হইবে তারা যেন পদে পদে আলো হাওয়া না আটকায়। বসিয়া যে থাকে তার সাজসজ্জা প্রচুর ভারী হইলেও চলে, কিন্তু চলাফেরা করিতে হইলে বোঝা হালকা করা চাই। লোকসান না করিয়া হালকা করিবার ভালো উপায়- বোঝাটাকে ভাগ করিয়া দেওয়া। আমাদের গানের বিপুল তনকর্তব ঐ হার্মানিবিভাগে চালান করিয়া দিলে মূল গানটার সহজ স্বরূপ ও গাম্ভীর্য রক্ষা পায়, অথচ তার গতিপথ খোলা থাকে। এক হাতে রাজদণ্ড, অন্য হাতে রাজছত্ৰ, কঁাধে জয়ধ্বজা এবং মাথায় সিংহাসন বহিয়া রাজাকে যদি চলিতে হয় তবে তাহাতে বাহাদুরি প্রকাশ পায় বটে, কিন্তু তার চেয়ে শোভন ও সুসংগত হয় যদি এই আসবাবগুলি নানা স্থানে ভাগ করিয়া দেওয়া হয়। তাতে সমারোহে বাড়ে বৈ কমে না। আমাদের গানের যদি অনুচর। বরাদ্দ হয়, তবে সংগীতের অনেক ভারী ভারী মালপত্র ঐদিকে চালান করিয়া দিতে পারি। যাই হােক, আমাদের সংগীতের পক্ষে এই একটা বড়ো মহল ফাঁকা আছে, এটা যদি দখল করিতে পারি। তবে এই দিকে অনেক পরীক্ষা ও উদভাবনার জায়গা পাইব। যৌবনের স্বভাবসিদ্ধ সাহস যাদের আছে এবং লক্ষ্মীছাড়ার ক্ষ্যাপা হাওয়া যাদের গায়ে লাগিল, এই একটি আবিষ্কারের দুৰ্গমক্ষেত্র তাদের সামনে পড়িয়া। আজ হোক কাল হােক, এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই লোক নামিবে