পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'नोउस्टि (d থেকে বুঝতে পারি সংগীত সম্বন্ধে আমাদের দেশের প্রকৃতি কী। আজ সভায় আমি সেই কথাটির আলোচনা করব। আমার মনে যে সুর জমে ছিল, সে সুর যখন প্রকাশিত হতে চাইলে তখন কথার সঙ্গে গলাগলি করে সে দেখা দিল। ছেলেবেলা থেকে গানের প্রতি আমার নিবিড় ভালোবাসা যখন আমাকে ব্যক্ত করতে গেল, তখন অবিমিশ্র সংগীতের রূপ সে রচনা করলে না। সংগীতকে কাব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে, কোনটা বড়ো কোনটা ছোটাে বোঝা গেল না। আকাশে মেঘের মধ্যে বাপাকারে যে জলের সঞ্চয় হয়, বিশুদ্ধ জলধারা-বর্ষণেই তার প্রকাশ। গাছের ভিতর যে রস গোপনে সঞ্চিত হতে থাকে, তার প্রকাশ পাতার সঙ্গে ফুলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। সংগীতেরও এই রকম দুই ভাবের প্রকাশ। এক হচ্ছে বিশুদ্ধ সংগীত আকারে, আর হচ্ছে কাব্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। মানুষের মধ্যে প্রকৃতিভেদ আছে, সেই ভেদ অনুসারে সংগীতের এই দুই রকমের অভিব্যক্তি হয়। তার প্রমাণ দেখা যায় হিন্দুস্থানে আর বাংলা দেশে। কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলা দেশে সংগীত কবিতার অনুচরা না হোক, সহচর বটে। কিন্তু পশ্চিম হিন্দুস্থানে সে স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ; বাণী তার ছায়েবানুগত”। ভজন-সংগীতের কথা যদি ছেড়ে দিই, তবে দেখতে পাই পশ্চিমে সংগীত যে বাকা আশ্রয় করে তা অতি তুচ্ছ । সংগীত সেখানে স্বতন্ত্র, সে আপনাকেই প্রকাশ করে । বাংলা দেশে হৃদয়ভাবের স্বাভাবিক প্রকাশ সাহিত্যে। ‘গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি'- সে দেখতে পাচ্ছি সাহিত্যের মধুচক্র থেকে। বাণীর প্রতিই বাঙালির অন্তরের টান ; এইজন্যেই ভারতের মধ্যে এই প্রদেশেই বাণীর সাধনা সব চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু এক বাণীর মধ্যে তো মানুষের প্রকাশের পূর্ণত হয় না- এইজন্যে বাংলা দেশে সংগীতের স্বতন্ত্র পঙক্তি নয়, বাণীর পাশেই তার আসন। এর প্রমাণ দেখো আমাদের কীর্তনে । এই কীর্তনের সংগীত অপরূপ কিন্তু সংগীত যুগল ভাবে গড়া--- পদের সঙ্গে মিলন হয়ে তবেই এর সার্থকতা। পদাবলীর সঙ্গেই যেন তার রাসলীলা ; স্বাতন্ত্র্য সে সইতেই পারবে না। সংগীতের স্বাতন্ত্র যন্ত্রে সব চেয়ে প্রকাশ পায়। বাংলার আপনি কোনো যন্ত্র নেই, এবং প্রাচীনকালেই হোক আর আধুনিক কালেই হোক, যন্ত্রে যাঁরা ওস্তাদ তারা বাংলার নন। বীণ রবাব শরদ সেতার এসরাজ সারেঙ্গী প্রভৃতির তুলনায় আমাদের রাখালের বঁশি বা বৈরাগীর একতারা কিছুই নয়। তা ছাড়া, গড়ের বাদের বীভৎস বাঙ্গরূপে বাংলা দেশে কন্সার্ট নামক যে যন্ত্রসংগীতের উৎপত্তি হয়েছে তাকে সহ্য করা আমাদের লজ্জা এবং তাতে আনন্দ’ পাওয়ায় আমাদের 되어 এই-সমস্ত লক্ষণ দেখে আমার বিশ্বাস হয় বাংলা দেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে একটি অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর প্রথাগত বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই ; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্বলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্যে উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না। এইজন্যে গানে বাণীকেও সুরের খাতিরে কিছু আপাস করতে হয়, তাকে সুরের উপযোগী হতে হয়। যাই হোক, বাংলা দেশে এই এক জাতের কাব্যকলা ক্রমশ ব্যাপক হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি। বাণীর মিলন-সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে। ' . . .