পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

अऔीलgि (ró(© বাউল-গান ৷ মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন বাউল-সংগীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ সম্বন্ধে পূর্বেই তীর সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমিও তাকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি। আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন তারা জানেন বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপআলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন-এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল- “ কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে! দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে। কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে ; তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ। যাকে জািনবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণবেদনা। আপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম তার গেয়ো সুরে সহজ ভাষায়- যাকে সকলের চেয়ে জানিবার তাকেই সকলের চেয়ে না জানিবার বেদনা-অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর- তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। ‘অন্তরতর যদীয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেক কাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চায়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দারদে যার তুলনা মেলে না- তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি নে। ] সকল সাহিত্যে যেমন লোকসাহিত্যেও তেমনি, তার ভালোমন্দের ভেদ আছে। কবির প্রতিভা থেকে যে রসধারা বয় মন্দাকিনীর মতো, অলক্ষ্যলোক থেকে সে নেমে আসে ; তার পর একদল লোক আসে যারা খাল কেটে সেই জল চাষের ক্ষেতে আনতে লেগে যায়। তারা মজুরি করে ; তাদের হাতে এই ধারার গভীরতা, এর বিশুদ্ধতা চলে যায়-কৃত্রিমতায় নানা প্রকারে বিকৃত হতে থাকে। অধিকাংশ আধুনিক বাউলের গানের অমূল্যতা চলে গেছে, তা চলতি হাটের সম্ভা দামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকোচ্ছে। তা অনেক স্থলে বাঁধি বােলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ-তার অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগীদলে টানবার প্রচারক গিরি। এর উপায় নেই, খাটি জিনিসের পরিমাণ বেশি হওয়া অসম্ভব-খাটির জন্যে অপেক্ষা করতে ও তাকে গভীর করে চিনতে যে ধৈর্যের প্রয়ােজন তা সংসারে বিরল। এইজন্যে । কৃত্ৰিম নকলের প্রচুরতা চলতে তাকে। এইজন্যে সাধারণত যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কী সাধনার কী সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশি নয়।