পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G? Ve Ve রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের আবাহন করে আনতে হবে। ভগীরথ যেমন ভস্মীভূত সগরসন্তানদের বাঁচাবার জন্যে পুণ্যতোয় গঙ্গাকে মর্ত্যে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন, তেমনি মানসলোকের ভগীরথেরা প্ৰাণহীনতার মধ্যে অমৃতত্ব সঞ্চারিত করবার জন্য আনন্দরসের বিচিত্র ধারাকে বহন করে আনবেন। সমস্ত বড়ো বড়ো জাতির মধ্যেই এই কাজ চলছে। চলছে বলেই তারা বড়ো। পার্লামেন্টে, বাণিজ্যের হাটে, যুদ্ধের মাঠে, তঁরা বুক ফুলিয়ে তাল ঠুকে বেড়ান বলেই তারা বড়ো তা নয়। তঁরা সাহিত্যে সংগীতে কলাবিদ্যায় সকল দেশের মানুষের জন্যে সকল কালের রসস্রোত জ্যৈষ্ঠ ১৩২ বিদেশীযাত্রার প্রাককালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ৰগণের অভিনন্দনে কথিত বক্তৃতার একাংশ ংলা দেশে নতুন একটা ভাব গ্রহণ করবার সাহস ও শক্তি আছে এবং আমরা তা বুঝিও সহজে। কেননা অভ্যাসের জড়তার বাধা আমরা পাই না। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। নতুন ভােব গ্রহণ করা সম্বন্ধে বুদ্ধির দিক থেকে বাধা থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু জড় অভ্যাসের বাধা পাওয়া বড়ো দুর্ভাগ্যের বিষয়। এই জড় অভ্যাসের বাধা অন্য প্রদেশের চেয়ে বাংলা দেশে কম বলে আমি মনে করি। প্রাচীন ইতিহাসেও তাই। বাংলায় যত ধর্মবিপ্লব হয়েছে তার মধ্যেও বাংলা নিজামাহান্ত্র্যের বিশিষ্ট প্রকাশ দেখিয়েছে। এখানে বৌদ্ধধর্ম বৈষ্ণবধর্ম বাংলার যা বিশেষ রূপ, গৌড়ীয় রূপ, তাই প্রকাশ করেছে। আর-একটা খুব বিস্ময়কর জিনিস এখানে দেখা যায়- হিন্দুস্থানী গান বাংলায় আমল পায় নি। এটা আমাদের দৈন্য হতে পারে। অনেক ওস্তাদ আসেন বটে গোয়ালিয়র হতে, পশ্চিমদেশ দক্ষিণদেশ হতে, যাঁরা আমাদের গান বাদ্য শেখাতে পারেন, কিন্তু আমরা সে-সব গ্রহণ করি নি। কেননা আমাদের জীবনের স্রোতের সঙ্গে তা মেলে না। আকবর শার সভায় তানসেন যে গান গাইতেন সাম্রাজ্যমন্দগর্বিত সম্রাটের কাছে তা উপভোগের জিনিস হতে পারে, কিন্তু আমাদের আপনার হতে পারে না। তার মধ্যে যে কারুনৈপুণ্য ও আশ্চর্য শক্তিমত্তা আছে তাকে আমরা ত্যাগ করতে পারি নে, কিন্তু তাকে আমাদের সঙ্গে মিশ খাইয়ে নেওয়া কঠিন। অবশ্য, নিজের দৈন্য নিয়ে বাংলা দেশ চুপ করে থাকে নি। বাংলা কি গান গায় নি ? বাংলা এমন গান গাইলে যাকে আমরা বলি কীর্তন। বাংলার সংগীত সমস্ত প্রথা- সংগীতসম্বন্ধীয় চিরাগত প্রথার নিগড় ছিন্ন করেছিল। দশকুশী বিশকুশী কত তালই বেরোল, হিন্দুস্থানী তালের সঙ্গে তার কোনোই যোগ নেই। খোল একটা বেরোল, যার সঙ্গে পাখোয়াজের কোনো মিল নেই। কিন্তু, কেউ বললে না। এটা গ্রাম্য বা অসাধু। একেবারে মেতে গেল সব- নোচে কুদে হেসে ভাসিয়ে দিলে। কত বড়ো কথা! অন্য প্রদেশে তো এমন হয় নি। সেখানে হাজার বৎসর আগেকার পাথরে-গাঁথা কীৰ্তিসমূহ যেমন আকাশের আলোককে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, তেমনি সংগীত সম্বন্ধেও সজীব চেষ্টা প্রতিহত হয়েছে। বাংলা দেশের সাহস আছে, সে মানে নি চিরাগত প্রথাকে। সে বলেছে, “আমার গান আমি গাইব।' সাহিত্যেও তাই। এখানে হয়তো অত্যুক্তি করবার একটা ইচ্ছা হতে পারে, কেননা আমি নিজে সাহিত্যিক বলে গর্বানুভব করতে পারি। ছন্দ ও ভাব সম্বন্ধে আমাদের গীতিকাব্য যে-একটা স্বাতন্ত্র্য ও সাহসিকতা দেখিয়েছে। অন্য দেশে তা নেই।