পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা (?br○ আমার জবাবদিহি পূর্বেই দুই-একবার তোমার কাছে দাখিল করেছি। তোমার জবানি তার রিপোর্ট কাগজে বেরিয়েছে, পড়েও দেখেছি। তাই কথাটা আরো একবার স্পষ্ট করা অনাবশ্যক বোধ হচ্ছে না। ‘’হিন্দুস্থানী গানের রীতি যখন রাজা বাদশাদের উৎসাহের জোরে সমস্ত উত্তর ভারতে একচ্ছত্র হয়ে বসল। তখনো বাঙালির মনকে বাঙালির কণ্ঠকে সম্পূর্ণ দখল করতে পারে নি। বাংলায় রাধাকৃষ্ণের লীলাগান দিলে হিন্দুস্থানী গানের প্রবল অভিযানকে ঠেকিয়ে। এই লীলারসের আশ্রয় একটি উপাখান ! সেই উপাখ্যানের ধারাটিকে নিয়ে কীর্তনগান হয়ে উঠল। १भाळलीं ! “স্বভাবতই পালাগানের রূপটি নাট্যরূপ। হিন্দুস্থানী সংগীতে নাট্যরূপের জায়গা নেই। উপমা যদি দেওয়া চলে তা হলে বলতে হবে ঐ সংগীতে আছে এক-একটি রত্যুের কৌটা। ওস্তাদ জহরী ঘটা ক’রে প্যাচ দিয়ে তার ঢাকা খোলে। আলোর ছটায় ছটায় তিনি লাগিয়ে দিকে দিকে তাকে ঘুরিয়ে দেখায়। সমজ্ঞদার তার জগত মিলিয়ে দেখে, তার দাম যাচাই করে। ব’লে দিতে পারে এটা হীরে না নীলা, চুনি না পান্না। ‘কীৰ্তন হচ্ছে রত্নমালা রূপসীর গলায় ; যেমন রসিক, সে প্রত্যেক রাতুটিকে প্রিয়কণ্ঠে স্বতন্ত্র করে দেখতে পায় না- দেখতে চায় না। রত্নগুলিকে আত্মসাৎ করে যে সমগ্র রূপটি নানা ভাবে হিপ্লোলিত, সেইটেই তার দেখবার বিষয়। কিন্তু, এটা হিন্দুস্থানী কায়দা নয়। ‘মনে পড়ছে- আমার তখন অল্প বয়স, সংগীতসমাজে গাটা-অভিনয় । ইন্দ্ৰ চন্দ্র দেবতারা নাটকের পাত্ৰ। উদ্যোগকর্তা অভিনেতারা ধনী ঘরের। সুতরাং দেবতাদের গায়ের গহনা না ছিল অল্প, না ছিল কুঁটাে, না ছিল কম দামের। সেদিন প্রধান দর্শক রাজোপাধিধারী পশ্চিম প্রদেশের এক ধনী। তাকে নাটকের বিষয় বোঝাবার ভার আমার উপরে; আমি পাশে বসে ! অল্পক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, সেখানে বসানো উচিত ছিল হামিলটনের দোকানের বেচনদারকে। মহারাজের একাগ্র কৌতুহল গয়নাগুলির উপরে! অথচ অলংকারশাস্ত্ৰে সামান্য যে পরিমাণ দখল আমার সে বাক্যালংকারের, রত্নালংকারে আমি আনাড়ি।

  • সেদিন অভিনয় না হয়ে যদি কীৰ্ত্তন হত তা হলেও এই পশ্চিমে মহারাজা গানের চেয়ে রাগিণীকে বেশি করে লক্ষ্য করতেন, সমগ্ৰ কলা সৃষ্টির সহজ সৌন্দর্যের চেয়ে স্বরপ্রয়োগের দুরূহ ও শাস্ত্রসন্মত কারুসম্পদের মূল্যবিচার করতেন— সে আসরেও আমাকে বোকার মতো বসে ४८:उं शड |

‘মোট কথা হচ্ছে- কীর্তনে জীবনের রাসলীলার সঙ্গে সংগীতের রাসলীলা ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত। জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মতো নতুন নতুন বঁাকে বঁাকে বিচিত্র। ডোবা বা পুকুরের মতো একটি ঘোর-দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধা নয়। কীর্তনে এই বিচিত্র বাঁকা ধারার পরিবর্তমান ক্ৰমিকতাকে কথায় ও সুরে মিলিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। . 'কীর্তনের আরো একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই। বাংলায় একদিন বৈষ্ণব ভাবের প্রাবল্যে ধর্মসাধনায় বা ধর্মরসভোগে একটা ডিমোক্রাসির যুগ এল। সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কণ্ঠে প্ৰকাশ পেতে চেয়েছিল। সে প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তায় ঘাটে। বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছাস গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল। এটা বাংলা দেশের ভূমিপ্রকৃতির মতোই। এই ভূমিতে পূর্ববাহিনী দক্ষিণবাহিনী বহু