পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(So অন্তরের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারো ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ, তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায় নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল, অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মীড় টানে,-আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে। শিলাইদহ । ৬ অক্টোবর ১৮৯১ পরশুদিন আমনি বোটের জানলার কাছে চুপ করে বসে আছি, একটা জেলেডিঙিতে একজন মাঝি গান গাইতে গাইতে চলে গেল— খুব যে সুস্বর তা নয়- হঠাৎ মনে পড়ে গেল বহুকাল হল ছেলেবেলায় বাবামশায়ের সঙ্গে বোটে করে পদ্মায় আসছিলুম-একদিন রাত্তির প্রায় দুটাের সময় ঘুম ভেঙে যেতেই বোটের জানলাটা তুলে ধরে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম। নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না হয়েছে, একটি ছোট্ট ডিঙিতে একজন ছোকরা একলা দাঁড় বেয়ে চলেছে, এমনি মিষ্টি গলায় গান ধরেছে— গান তার পূর্বে তেমন মিষ্টি কখনো শুনি নি। হঠাৎ মনে হল আবার যদি জীবনটা ঠিক সেইদিন থেকে ফিরে পাই! আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যায়- এবার তাকে আর তৃষিত শুদ্ধ অপরিতৃপ্ত করে ফেলে রেখে দিই নে- কবির গান গলায় নিয়ে একটি ছিপছিপে ডিঙিতে জোয়ারের বেলায় পৃথিবীতে ভেসে পড়ি, গান গাই এবং বশ করি এবং দেখে আসি পৃথিবীতে কোথায় কী আছে; আপনাকেও একবার জানান দিই, অন্যকেও একবার জানি ; জীবনে যৌবনে উচ্ছসিত হয়ে বাতাসের মতো একবার হু হু করে বেড়িয়ে আসি, তার পরে ঘরে ফিরে এসে পরিপূর্ণ প্ৰফুল্ল বাৰ্ধক্য কবির মতো কটাই। সাজাদপুর। ৫ জুলাই ১৮৯২ আজ সকালে একটা সানাইয়েতে ভৈরবী বাজাচ্ছিল, এমনি অতিরিক্ত মিষ্টি লাগছিল যে সে আর কী বলব- আমার চােখের সামনেকার শূন্য আকাশ এবং বাতাস পর্যন্ত একটা অন্তর নিরুদ্ধ ক্ৰন্দনের আবেগে যেন স্ফীত হয়ে উঠছিল- বড়ো কাতর কিন্তু বড়ো সুন্দর- সেই সুরাটাই ভিতরে কেন এত বেশি ভােব প্রকাশ করে! এখন আবার তারা মুলতান বাজাচ্ছে-মনটা বড়োই উদাস করে দিয়েছে- পৃথিবীর এই সমস্ত সবুজ দৃশ্যের উপরে একটি অশ্রুবাম্পের আবরণ টেনে দিয়েছে- এক-পর্দা মুলতান রাগিণীর ভিতর দিয়ে সমস্ত জগৎ দেখা যাচ্ছে। যদি সব সময়েই এই রকম এক-একটা রাগিণীর ভিতর দিয়ে জগৎ দেখা যেত, তা হলে বেশ হত। আমার আজকাল ভারি গান শিখতে ইচ্ছে করে- বেশ অনেকগুলো ভূপালী... এবং করুণ বর্ষার সুরঅনেক বেশ ভালো ভালো হিন্দুস্থানী গান-গান প্রায় কিছুই জানি নে বললেই হয়। সাজাদপুর। ১০ জুলাই ১৮৯৩ "বড়ো বেদনার মতো” গানের সূরটা ঠিক হয়তো মজলিসি বৈঠকি নয়।. এ-সব গান যেন একটু নিরালায় গাবার মতো। সুরাটা যে মন্দ হয়েছে এমন আমার বিশ্বাস নয়, এমন-কি ভালো হয়েছে বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হয় না। ও গানটা আমি নাবার ঘরে অনেক দিন একটু একটু করে সুরের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করেছিলুম-নাবার ঘরে গান তৈরি করবার ভারি কতকগুলি সুবিধা