পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা by & | Šv(o আমি বারবার দেখেছি। বর-ঠকানে প্রশ্ন তুলে আমাকে আক্রমণ করতে তোমার যেন একটা সিনিস্টর আনন্দ আছে। এবারে কিন্তু সময় খারাপ। ভিনগাঁয়ে যেতে হবে, লেকচার দেবার ডাক পড়েছে। মনের মধ্যে কথা বয়ন করবার যে তঁাতটা ছিল, এতকাল সে ফরমাশ খেটেছে বিস্তর; এখন ঘনঘন টানা-পোড়েন। আর সয় না, কথায় কথায় সুতো যায় ছিড়ে । তুমি যে প্রশ্ন করেছ তার উত্তর সেদিনকার বকুনির মধ্যে কোনো-একটা জায়গায় ছিল বলে মনে হচ্ছে। বোধ হয় যেন বলেছিলুম ঘরবাড়ি বালাখানা আপন-খেয়াল-মত বানানো চলে, কিন্তু যে ভূতলের উপর তাকে খাড়া করতে হবে সেই চিরকেলে আধারের সঙ্গে তার রফা করাই চাই। তুমি জানো সংগীতে আমি নির্মমভাবে আধুনিক, অর্থাৎ জাত বঁচিয়ে আচার মেনে চলি নে। কিন্তু একেবারেই ঠাট বজায় না। রাখি যদি তবে সেটা পাগলামি হয়ে দাঁড়ায়। শিশুকালে শিশুবোধে দেখেছি প্ৰেয়সীকে পত্র লেখবার বিশেষ পাঠ ও রীতি বেঁধে দেওয়া ছিল, সেটাতে তখনকার কালের প্রবীণদের সম্মতি ছিল সন্দেহ নেই। তর্কের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক, প্ৰেমলিপি লেখবার সেই ছাঁদ যথার্থই অত্যন্ত মনোহর-কিন্তু, কালান্তর ঘটতেই, অর্থাৎ যৌবনকাল উপস্থিত হতেই দেখা যায় সে ভাষায় কোনো পক্ষের মেজাজ, সায় দেয় না। তখন স্বতই যে ভাষা দেখা দেয় তার মধ্যে পিতৃপিতামহদের অনুমোদিত ধ্রুবনির্দিষ্ট শব্দলালিত্য ও রচনানৈপুণ্য না থাকতে পারে, বাকরণের বিশেষত বানানের ভুলচুক থাকাও অসম্ভব নয়, দুটাে-একটা ইংরেজি শব্দও তার মধ্যে হয়তো অগতা ঢুকে পড়ে, কিন্তু শুচিবায়ুগ্ৰস্ত মুরুব্বিারা যাই বলুন-না-কেন তার মধ্যে যে সহজ রসসঞ্চার হয় তাকে অবজ্ঞা করা চলবে না। সেই মুরুব্বিারাই যদি ষোড়শী চতুর্থপক্ষীয়ার দিকে দুৰ্নিবার ধাক্কায় ঝুকে পড়েন, তবে হঠাৎ দেখা যাবে তাদের ভাষাও শিকল ছিড়েছে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও মূল ভাষাটা বাংলা, সেখানে সেকাল একালের নাভীর ষোেগ। এই ভাষা বহু শতাব্দীর বঙ্গ নরনারীর বিচিত্ৰ ভাবনা কামনা ও বেদনার নিরন্তর অভিঘাতে বিশেষভাবে প্ৰাণময় চিন্ময় দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে, বিশেষভাবে বাঙালির চিন্তা ও ইচ্ছাকে রূপ দেবার জনোই তার সৃষ্টি। এইজনো, কোনো বাঙালির যতই প্রতিভার জোর থােক, বিদেশী ভাষার ভূমিতে সাহিত্যের কীৰ্তিস্তম্ভ সে স্থায়ীভাবে গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের বাংলা ভাষার রূপ বদল হচ্ছে নিয়তই, বদল হতে যে পারে এই তার মহৎ গুণ-কিন্তু, সমস্ত বদল হবে তার আদি-প্রকৃতির উপর ভর। গান সম্বন্ধেও এই কথাই খাটে। ভারতবর্ষের বহু-যুগের-সৃষ্টি-করা যে সংগীতের মহাদেশ, ৩াকে অস্বীকার করলে দাঁড়াবা কোথায়? পশ্চিম মহাদেশেও বাসযোগ্য স্থান নিশ্চিত আছে, কিন্তু সেখানে ভাড়াটে বাড়ির ভাড়া জোগাব কোথা থেকে ? বাংলা দেশে আমার নামে অনেক প্রবাদ প্রচলিত ; তারই অন্তৰ্গত একটি জনশ্রুতি আছে যে, আমি হিন্দুস্থানী গান জানি নে, বুঝি নে। আমার আদিযুগের রচিত গানে হিন্দুস্থানী ধ্রুবপদ্ধতির রাগরাগিণীর সাক্ষী-দল অতি বিশুদ্ধ প্রমাণ সহ দূর ভাবীশতাব্দীর প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিদারুণ বাদবিতণ্ডার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। ইচ্ছা! করলেও সংগীতকে আমি প্রতাখান করতে পারি। নে ; সেই সংগীত থেকেই আমি প্রেরণা লাভ। করি এ কথা যারা জানে না তারাই হিন্দুস্থানী সংগীত জানে না। হিন্দুস্থানী গানকে আচারের শিকলে যাঁরা আচল করে বেঁধেছেন, সেই ডিক্যাটটারদের আমি মানি না। যাঁরা বলেন ভারতীয়