পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V\8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তখন লুব্ধ মন বলতে চায়, না। আর বেশি কাজ নেই। অথচ "আর বেশি কাজ নেই' কথাটাই আর্টের অন্তরের কথা। আর্টের খাতিরেই যথাস্থানে বলা চাই ; ব্যস, চুপ, আর এক বর্ণও না। সংস্কৃত সাহিত্যে সংস্কৃত ভাষার একটি প্রধান সম্পদ ধ্বনিগৌরব। সেই কারণে কোনো কৌশলী লেখক যদি পাঠকের কান অভিভূত ক’রে ধ্বনিমন্দ্ৰিত শব্দ বিস্তার করে চলে, তবে অনেক ক্ষেত্রে তার অপরিমিতি নিয়ে পাঠক নালিশ উপস্থিত করে না। তার একটা দৃষ্টান্ত কাদম্বরী। শূদ্ৰক রাজার অত্যুক্তিবহুল বর্ণনা চলল। তিন-চার পাতা জুড়ে ; লেখকের কলমটা হাঁপিয়ে উঠে থামল, বস্তুত থামবার কোনো কলাগত। কারণ ছিল না। এ কথা বলে কোনো ফল হয় না যে এতে সমগ্ৰ গল্পের পরিমাণ-সামঞ্জস্য নষ্ট হচ্ছে। কেননা, পাঠক থেকে থেকে বলে উঠছে, ‘বাহবা, বেশ লাগছে।’ বেশ লাগছে বলেই বিপদ ঘটল, তাই বাণীরা প্ৰগলভতায় বীণাপাণি হার মেনে চুপ করে গেলেন! তার পরে এল ব্যাধের মেয়ে, শুকপাখির খাঁচা হাতে নিয়ে। বন্যা বইল বৰ্ণনার, তাঁটের রেখা লুপ্ত হয়ে গেল, পাঠক বললে, “বেশ লাগছে। এই বেশ লাগা পরিমাণ মানে না। এমন স্থলে রচনার সমগ্রতাটা বাহন হয়ে দাসত্ব করে তার উপকরণের, সে আপন পূর্ণতার মাহাত্ম্যকে অকাতরে চাপা পড়তে দেয় আপন স্তুপাকার দ্রব্যসম্ভারের তলায়। সংস্কৃত সাহিত্যে কাদম্বরীর ছাদে গল্পরচনা আর দুটি-একটি মাত্র দৃষ্টান্ত লাভ করেছে ; ও আর চলল না। যেমন একদা মেগাথেরিয়ম ডাইনসর প্রভৃতি অতিকায় জন্তু আপনি অসংগত অতিকৃতির বোঝা অধিক দিন বইতে পারল না, গেল লুপ্ত হয়ে, এও তেমনি। সংস্কৃত সাহিত্য-অভিমানী কোনো দুঃসাহসিক আজ কাদম্বরীর অনুসরণে বাংলায় গল্প লেখবার চেষ্টা করবেই না- তার কারণ, ওর মধ্যে শিল্পের সদাচার নেই। কিন্তু আমাদের সংগীতে আজও কাদম্বরীর পালা চলছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের সংস্রবে এসেছে ; তাই আমাদের এমন একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে যে, এই সাহিত্যে কলাতত্ত্বের মূলগত ব্যতিক্রম ঘটা অসম্ভব। কিন্তু, হিন্দুস্থানী গান ব্যবসায়ী গায়কদের গতানুগতিক রবারনির্মিত ঝুলির মধ্যে রয়ে গেছে। বিশ্বজনীন আদর্শের সঙ্গে তার পার্থক্য ঘটলেও মন ও কানের অভ্যাসে বিরোধ ঘটবার সুযোগ হয় না। আজকালকার দিনে যাঁদের শিক্ষা ও রুচি বিশ্বচিত্তের মধ্যে প্রবেশাধিকার পেয়েছে তারা যখন স্বাধীন মন নিয়ে বহুল সংখ্যায় গানের চর্চায় প্রবৃত্ত হবেন, তখন সংগীতে কলার সম্মান পণ্ডিত্যের দম্ভ ছাড়িয়ে যাবে। তখন কোন ভালো লাগা যথার্থ আর্টের এলাকার, অন্তত সমাজদারের কাছে তা স্পষ্ট হতে পারবে। ইতি ১৫ই মে ১৯৩৫ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনার শেষ পত্রের উত্তরে আমি বলতে চাই যে, কোনো গায়ক, কোনো আলাপিয়াও, রূপসৃষ্টির দায়িত্ব থেকে মুক্ত নয়। এ কথা আমি সর্বািন্তঃকরণে স্বীকার করি। কিন্তু দুটি সন্দেহ রয়ে গেল । . - । প্রথমত মানছি যে, ছোটের মধ্যে রূপ ফুটতে পারে, বড়োর মধ্যেও । কিন্তু great music কিংবা great poetry কি ভিন্ন শ্রেণীর নয়? ঐশ্বর্য দেখানোটা বর্বরতা নিশ্চয়ই, কিন্তু চারপদী দরবারী কানাড়ার তানসেনী ধ্রুপদ ও খাম্বাজের ঠুংরির মধ্যে পার্থক্য আছেই। যদি কোনো উৎকৃষ্ট