পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や8の রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মধ্যে পঙক্তিভেদ আছে। অনুভূতিতে ইটালীয় এবং নারবেজীয় এক নয়, ইংরেজ এবং ফরাসির মধ্যেও প্রভেদ আছে। সে কেবলমাত্র ওদের রাষ্ট্রচালনায় নয়, ওদের শিল্পভাবনায় প্রকাশ পায়। বলা বাহুল্য জার্মান ও ফরাসির চরিত্র ভিন্ন। জর্মানি ও ইটালির ভৌগোলিক দূরত্ব অল্পই। কিন্তু ইটালির সীমা পেরিয়ে জার্মানিতে প্রবেশ করবামাত্ৰই উভয় দেশের লোকের প্রকৃতিগত প্রভেদ সুস্পষ্ট অনুভব করা যায়। এই প্রভেদটি কুলক্রমে রক্তমাংস অস্থিমজ্জায় সঞ্চারিত হয়ে চলেছে অথবা বাইরের নানা ঐতিহাসিক কারণে এটা সংঘটিত- সে তর্ক আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে অনাবশ্যক। ভিন্ন ভিন্ন গণজাতির মধ্যে চরিত্রগত হাদয়গত প্ৰভেদ অন্তত দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। এ কথা মানতেই হবে, চিরকাল চলবে কি না সে আলোচনা অবাস্তর। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের বুদ্ধির ক্ষেত্র সমভূমি না হলেও, এক মাটির। সেখানে চাষ করতে করতে ক্ৰমে অনুরূপ ফসল ফলানো যেতে পারে। তার প্রমাণ জাপান। সেখানকার মাটিতে পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক সায়ান্স শিকড় চালিয়ে দিয়ে পাশ্চাত্য শস্যের ফলনে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যুরোপের বৌদ্ধিক প্রকৃতিকে সাধনাদ্বারা আমরা অঙ্গীকৃত করতে পারি তার কিছু কিছু প্রমাণ দেওয়া গেছে। কিন্তু, তার চরিত্রকে পাচ্ছি নে, নানা শোচনীয় ব্যর্থতায় সেটা প্ৰত্যহ সুস্পষ্ট शब्ल । চরিত্র কর্মসৃষ্টিতে এবং হৃদয়বৃত্তি ও ক্তি রসসৃষ্টিতে আপন পরিচয় দিয়ে থাকে। তাই যুরোপীয় সংগীতের কাঠামো এক হলেও ইটালীয় ও জর্মান সংগীতের রূপের ভেদ আপনিই ঘটেছে। ও দিকে রুশীয় সংগীতেরও বৈশিষ্ট্য রসজ্ঞেরা স্বীকার করেন। হিন্দুস্থানীর সঙ্গে বাঙালির প্রভেদ আছে, দেহে, মনে, হৃদয়ে, কল্পনায়। বুদ্ধির পার্থক্য হয়তো দূর করা যায়। একজাতীয় শিক্ষার দ্বারা ; কিন্তু স্বভাবের যে দিকটা অন্তরগুঢ় তার উপরে হাত চালানো সহজ নয়। আমাদের ধীশক্তিটা দারোয়ান ; কোন তথ্যটাকে রাখবে, কাকে খেদিয়ে দেবে, গোঁফে চাড়া দিয়ে সেটা ঠিক করতে থাকে-আক্রমণ ও আত্মরক্ষার কাজেও তার বাহাদুরি আছে- সে থাকে মনের দেউড়ি জুড়ে। কিন্তু অন্তঃপুরের কাজ আলাদা— সেইখানেই সাজসজ্জা, নাচগান, পূজা অৰ্চনা, সেবার নৈবেদ্য, মনোরঞ্জনের আয়োজন। কুচকাওয়াজ প্রভৃতি নানা উপায়ে দারোয়ানটার পালোয়ানির উৎকর্ষসাধনের একটা সাধারণ আদর্শ আমরা বৈজ্ঞানিক পাড়া থেকে আহরণ করতে পারি, কিন্তু অন্তঃপুরিকাদের এক ছাদে গড়তে গেলে হাই-হিলড় জুতোর উপর দাঁড়িয়েও ভিতর থেকে তাদের ছাদ আলাদা হয়ে বেরিয়ে পড়ে, কেবল সেই অংশে মেলে যেটা তাদের স্বভাবের সঙ্গে স্বতই সংগত। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, বাংলা সংস্কৃতির। যদি অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্ট্য থাকেই তবে সেটা কি পুরাতনের পুনরাবৃত্তিরূপেই প্ৰকাশিত হতে থাকবে? কখনোই না। কারণ, অপরিবর্তনীয় পুনরাবৃত্তি তো প্ৰাণধর্মের বিরুদ্ধ। সেকেলে কবির গানে, পাঁচালি প্রভৃতিতে বাঙালি রুচির একটা আদর্শ নিশ্চয়ই পাওয়া যায় ; কিন্তু কালক্রমে তার কোনো পরিণতি যদি না ঘটে। তবে বলতে হবে সে আদর্শ মরেছে। শিশুকে বড়ো হতে হবে।--সেই পরিবৃদ্ধির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ঐক্যসূত্র বরাবর থাকে, কিন্তু অন্তরে বাইরে বদল হয় বিস্তর। তার সজীব কলেবরটা বাহিরের নানা উপাদান সংগ্রহ করতে থাকে, নতুন নতুন অবস্থার সঙ্গে মিল ঘটিয়ে চলে, নতুন পাঠশালায় নতুন নতুন শিক্ষালাভ করে। তার প্রভুত পরিণতি ও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু, মূল প্ৰাণের সূত্র যার দুর্বল, পুনরাবৃত্তি বই তার আর-কোনো গতি নেই। সেই পুনরাবৃত্তির অভাব দেখলেই প্রথার দোহাই পাড়তে থাকে যে বুদ্ধি, সে শবাসনা।