পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী হয়েছে আর সূর্যমুখীর ব্যবহারে সতীর কর্তব্যে কতটুকু খুঁত দেখা দিল। ভ্ৰমর সূর্যমুখী সকল অপরাধ সত্ত্বেও কতখানি সত্য আর্টে সেটাই মুখ্য, তারা কতখানি সতী সেটা গৌণ, এ কথার মূল্য তাদের কাছে নেই ; তারা আদর্শের অতিনিখুঁতত্বে ভাবে বিগলিত হয়ে অশ্রুপাত করতে চায়। উপনিষৎ বলেছেন আত্মার মধ্যে পরম সত্যকে দেখবার উপায় শাস্তোদান্ত উপরিতক্তিতিক্ষুঃ সমাহিতো ভূত্বা”। আর্টের সত্যকেও সমাহিত হয়ে দেখতে হয়, সেই দেখবার সাধনায় কঠিন শিক্ষার প্রয়োজন আছে। ংলা দেশে সম্প্রতি সংগীতচর্চার একটা হাওয়া উঠেছে, সংগীতরচনাতেও আমার মতো অনেকেই প্ৰবৃত্ত। এই সময়ে প্রাচীন ক্লাসিক্যাল অর্থাৎ ধ্রুবপদ্ধতির হিন্দুস্থানী সংগীতের ঘনিষ্ঠ পরিচয় নিতান্তই আবশ্যক। তাতে দুর্বল রসমুগ্ধতা থেকে আমাদের পরিত্রাণ করবে। এ কিন্তু অনুশীলনের জন্যে, অনুকরণের জন্যে নয়। আর্টে যা শ্রেষ্ঠ তা অনুকরণজাত নয়। সেই সৃষ্টি আর্টিস্টের সংস্কৃতিবান মনের স্বকীয় প্রেরণা থেকে উদ্ভূত। যে মনোভাব থেকে তানসেন প্রভৃতি বড়ো বড়ো সৃষ্টিকর্তা দরবারীতোড়ি দরবারীকানাড়াকে তঁদের গানে রূপ দিয়েছেন সেই মনোভাবটিই সাধনার সামগ্ৰী, গানগুলির আবৃত্তিমাত্র নয়। নতুন যুগে এই মনোভাব যা সৃষ্টি করবে: সেই সৃষ্টি তাদের রচনার অনুরূপ হবে না, অনুরূপ না হতে দেওয়াই তাদের যথার্থ শিক্ষাকেননা, তঁরা ছিলেন নিজের উপমা নিজেই। বহু যুগ থেকে তঁদের সৃষ্টির পরে আমরা দাগা বুলিয়ে এসেছি, সেটাই যথার্থত তাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া। এখনকার রচয়িতার গীতশিল্প তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু সেটা যদি এখনকার স্বকীয় আত্মপ্রকাশ হয় তা হলে তাতে করেই সেই- সকল গুণীর প্রতি সম্মান, প্ৰকাশ করা হবে। সব শেষে নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই। মাঝে মাঝে গান রচনার নেশায় যখন আমাকে পেয়েছে তখন আমি সকল কর্তব্য ভুলে তাতে তলিয়ে গেছি। আমি যদি ওস্তাদের কাছে গান শিক্ষা করে দক্ষতার সঙ্গে সেই সকল দুরূহ গানের আলাপ করতে পারতুম তাতে নিশ্চয়ই সুখ পেতুম ; কিন্তু আপনি অন্তর থেকে প্রকাশের বেদনাকে গানে মূর্তি দেবার যে আনন্দ, সে তার চেয়ে গভীর। সে গান শ্রেষ্ঠতায় পুরাযুগের গানের সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু আপনি সত্যতায় সে সমাদরের যোগ্য। নব নব যুগের মধ্যে দিয়ে এই আত্মসত্যপ্রকাশের আনন্দধারা যেন প্রবাহিত হতে থাকে এইটেই বাঞ্ছনীয়। প্ৰথম বয়সে আমি হৃদয়ভােব প্ৰকাশ করবার চেষ্টা করেছি। গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি। পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব-বাংলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য। তৎসংশ্লিষ্ট কাব্যগুলিও অধিকাংশই রূপের বাহন। কোন বাজাও কঁকন কনকন কত হুলভারে- এতে যা প্রকাশ পাচ্ছে তা কল্পনার রূপলীলা। ভাবপ্রকাশে ব্যথিত হৃদয়ের প্রয়োজন আছে, রূপ প্ৰকাশ অহৈতুক। মালকোষের চৌতাল যখন শুনি তাতে কান্নাহাসির সম্পর্ক দেখি নে, তাতে দেখি গীতরূপের গভীরতা। যে বিলাসীরা টপ্পা ঠুংরি বা মনোহরাসাঞী কীর্তনের অশ্রু-আর্ক্স অতিমিষ্টতায় চিত্ত বিগলিত করতে চায়, এ গান তাদের জন্য নয়। আর্টের প্রধান আনন্দ বৈরাগ্যের আনন্দ, তা ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ হৰ্ষশোক থেকে মুক্তি দেবার জন্যে। সংগীতে সেই মুক্তির রূপ দেখা গেছে। ভৈরোঁতে, কল্যাণে, কানাড়ায়। আমাদের গান মুক্তির সেই উচ্চশিখরে উঠতে পারুক বা না পারুক, সেই দিকে ওঠবার চেষ্টা করে যেন। ইতি ১৩ই জুলাই ১৯৩৫ (Norfolk রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর