পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় もぬー বালি। ৩১ আগস্ট ১৯২৭ - এখানকার প্রকৃতি বালিনী ভাষায় কথা কয় না- সেই শ্যামার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি আর অরসিক মোটর-গাড়িটাকে মনে মনে অভিশাপ দিই। মনে পড়ল কখনো কখনো শুষ্কচিত্ত গাইয়ের মুখে গান শুনেছি ; রাগিণীর যেটা বিশেষ দরদের জায়গা, যেখানে মন প্রত্যাশা করছে গাইয়ের কণ্ঠ অতু্যচ্চ আকাশের চিলের মতো পাখাটা ছড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ স্থির থাকবে কিংবা দুই-একটা মাত্র মীড়ের ঝাপটা দেবে, গানের সেই মর্মস্থানের উপর দিয়ে যখন সেই সংগীতের পালোয়ান তার তানগুলোকে লোটন-পায়রার মতো পালটিয়ে পালটিয়ে উড়িয়ে চলেছে, তখন কিরকম বিরক্ত হয়েছি। [বালি] ৭ সেপ্টেম্বর ১৯২ এক-একটি জাতির আত্মপ্রকাশের এক-একটি বিশেষ পথ থাকে। বাংলা দেশের হৃদয় যেদিন আন্দোলিত হয়েছিল, সেদিন সহজেই কীর্তনগানে সে আপনি আবেগসঞ্চারের পথ পেয়েছে ; এখনো সেটা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নি। এখানে এদের প্রাণ যখন কথা কইতে চায় তখন সে নাচিয়ে তোলে। মেয়ে নাচে, পুরুষ নাচে। এখানকার যাত্ৰা অভিনয় দেখেছি ; তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চলায়-ফেরায়, যুদ্ধে-বিগ্রহে, ভালোবাসার প্রকাশে, এমন-কি ভাড়ামিতে, সমস্তটাই নাচ। ...বিশুদ্ধ নাচও আছে। পরশু রাত্রে সেটা গিয়ািনয়ারের রাজবাড়িতে দেখা গেল। সুন্দর-সাজকরা দুটি ছোটো মেয়ে-মাথায় মুকুটের উপর ফুলের দণ্ডগুলি একটু নড়াতেই দুলে ওঠে। গামেলান বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে দুজনে মিলে নাচতে লাগল। এই বাদ্যসংগীত আমাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। আমাদের দেশের জলতরঙ্গ বাজনা আমার কাছে সংগীতের ছেলেখেলা বলে ঠেকে। কিন্তু, সেই জিনিসটিকে গভীর, প্রশস্ত, সুনিপুণ, বহু যন্ত্রমিশ্ৰিত বিচিত্র আকারে এদের বাদ্যসংগীতে যেন পাওয়া যায়। রাগরাগিণীতে আমাদের সঙ্গে কিছুই মেলে না; যে অংশ মেলে সে হচ্ছে এদের মৃদঙ্গর ধ্বনি, সঙ্গে করতালও আছে। ছোটাে বড়ো ঘণ্টা এদের সংগীতের প্রধান অংশ। আমাদের দেশের নাট্যশালায় কন্সট্র বাজনার যে নূতন রীতি হয়েছে। এ সে রকম নয় ; অথচ, যুরোপীয় সংগীতে বহু যন্ত্রের যে হার্মানি এ তাও নয়। ঘণ্টার মতো শব্দে একটা মূল স্বরসমাবেশ কানে আসছে; তার সঙ্গে নানা প্রকার যন্ত্রের নানারকম আওয়াজ যেন একটা কারুশিল্পে গাঁথা হয়ে উঠছে। সমস্তটাই যদিও আমাদের থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র, তবু শুনতে ভারি মিষ্টি লাগে। এই সংগীত পছন্দ করতে য়ুরোপীয়দেরও বাধে না।. গামেলান সংগীতের কথা পূর্বেই বলেছি। ইতিমধ্যে এ সম্বন্ধে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে। এরা-যে আপন-মনে সহজ আনন্দে গান গায় না, তার কারণ এদের কণ্ঠসংগীতের অভাব। এরা টিং টিং টুং টাং করে যে বাজনা বাজায় বস্তুত তাতে গান নেই, আছে তাল। নানা যন্ত্রে এরা তালেরই বোল দিয়ে চলে। এই বোল দেবার কোনো-কোনো যন্ত্র ঢাক-ঢোলের মতোই, তাতে স্বর অন্ন, শব্দই বেশি ; কোনো-কোনো যন্ত্র ধাতুতে তৈরি, সেগুলি স্বরবান। এই ধাতু যন্ত্রে টানা সূর থাকা সম্ভব নয়, থাকবার দরকার নেই, কেননা টানা সুর গানেরই জন্যে-বিচ্ছিন্ন সুরগুলিতে তালেরই বোল দেয়।