পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SV)A রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়া থাকেন। আবার এমন অনেক ভীরু-স্বভাব পাঠক আছেন, যাহারা খ্যাতনামা লেখকের রচনা পাঠ্যকালে কোনো দোষ দেখিলে তাহাকে দোষ বলিয়া মনে করিতে ভয় পান, তাহারা মনে করেন এগুলি গুণই হইবে, আমি ইহার গভীর অর্থ বুঝিতে পারিতেছি। আমাদের পাঠকসমাজের রুচি ইংরাজি-শিক্ষার ফলে একাংশে যেমন উন্নত হইয়াছে অপরাংশে তেমনি বিকৃতি প্ৰাপ্ত হইয়াছে। ভ্রমর, কোকিল, বসন্ত লইয়া বিরহ বর্ণনা করিতে বসা তাহাদের ভালো না লাণ্ডক, কবিতার অন্যসকল দোষ ইংরাজি গিলটিতে আবৃত করিয়া তীহাদের চক্ষে ধরে তাহারা অন্ধ হইয়া যাইবেন। ইহারা ভাববিহীন মিষ্ট ছত্রের মিলনসমষ্টি বা শব্দাড়ম্বরের ঘনঘটাচ্ছন্ন শ্লোককে মুখে কবিতা বলিয়া স্বীকার করিতে লজ্জিত হন। কিন্তু কার্যে তাহার বিপরীতচরণ করেন। শব্দের মিষ্টতা অথবা আড়ম্বর তাঁহাদের মনকে এমন আকৃষ্ট করে যে পরিচ্ছদে আবৃত করিলে আমাদের চক্ষু পরিচ্ছদের দিকেই আকৃষ্ট হয়, ওই পরিচ্ছদ সেই কুগ্ৰী ব্যক্তির কদৰ্যতা কিয়ৎ পরিমাণে প্রচ্ছন্ন করিতেও পারে। কিন্তু তাহা বলিয়া তাহাকে সৌন্দৰ্য আপণ করিতে পারে না। II আমরা এবারে যে মেঘনাদবধের একটি রীতিমতো সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠক বিরক্ত হইয়া কহিবেন যে অত সূক্ষ্ম সমালোচনা করিয়া পুস্তকের দোষগুণ ধরা অনাবশ্যক, মোটের উপর পুস্তক ভালো লাগিলেই হইল। আমরা বলি এমন অনেক চিত্রকর আছেন, যাহারা বর্ণপ্রাচুর্যে তঁহাদের চিত্র পূর্ণ করেন, সে চিত্র দূর হইতে সহসা নয়ন আকর্ষণ করিলেও প্রকৃত শিল্পরসজ্ঞ ব্যক্তি সে চিত্রকারেরও প্রশংসা করেন না, সে চিত্রেরও প্রশংসা করেন না, তাহারা বিশেষ বিশেষ করিয়া দেখেন যে, চিত্রে ভাব কেমন সংরক্ষিত হইয়াছে, এবং ভাবসুদ্ধ চিত্ৰ দেখিলেই তাহারা তৃপ্ত হন। কাব্য সম্বন্ধেও ওইরূপ বলিতে পারা যায়। আমরা অধিক ভূমিকা করিতে অতিশয় অনিচ্ছক, এখন যে সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গিয়াছে তাহারই অবতারণা করা যাক । লক্ষ্মণ, ইন্দ্ৰজিৎ, রাবণ, সীতা, প্রমীলা, ইন্দ্ৰ, দুর্গ, মায়াদেবী, লক্ষ্মী ইহারাই মেঘনাদবধের প্রধান চরিত্র। ইহার মধ্যে কতকগুলি চরিত্র সুচিত্রিত হয় নাই, এবং কতকগুলি আমাদের মনের মতো হয় নাই। প্রথম, পুস্তক আরম্ভ করিতেই রাবণকে পাই। প্ৰথমে আমরা ভাবিলাম, কী একটি ভীষণ চিত্ৰই পাইব, গগনস্পশী বিশাল দশানন গভীর, ভীষণ, অন্ধকারময় মূর্তিতে উচ্চ প্ৰকাণ্ড সভামণ্ডপে আসীন, কিন্তু তাহা নহে, তাহা খুজিয়া পাই না। পাঠক প্রথমে একটি স্ফটিকময় রত্নরাজিন্সম্যাকুল সভায় প্রবেশ করো; সেখানে বসন্তের বাতাস বহিতেছে, কুসুমের গন্ধ আসিতেছে, চন্দ্ৰাননা চারুলোচনা কিংকরী চামর ঢুলাইতেছে, মদনের প্রতিরূপ ছত্রধর ছত্র ধরিয়া আছে, যাহা এক ভীষণের মধ্যে আছে দেীবারিক, কিন্তু দীেবারিককে মনে করিতে গিয়া শিবের রুদ্রভাব কমাইতে হয়। কবি পাণ্ডবশিবির-দ্বারে শূলপাণি রুদ্ৰেশ্বরের সহিত দ্বারবানের তুলনা দিয়াছেন। পুষ্করিণীর সহিত সমুদ্রের তুলনা দিলে সমুদ্রকেই ছোটাে বলিয়া মনে হয়। কেহ বলিবেন যে, রামায়ণের রাবণ রত্নরাজিন্সম্যাকুলিত সভাতেই থাকিত, সুতরাং মেঘনাদবধ অন্যরাপ কী করিয়া বর্ণিত হইবে? আমরা বলি রত্নরাজিসংকুল সভায় কি গাভীর্য অর্পণ করা যায় না? বাল্মীকি রাবণের সভা বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন, ‘রাবণের সভা তরঙ্গসংকুল, নক্ৰকুম্ভীর ভীষণ সমুদ্রের ন্যায় গভীর। বাংলার একটি ক্ষুদ্র কাব্যের সহিত বাল্মীকির বিশাল কাব্যের তুলনা করিতে যাওয়াও যা, আর মহাদেবের সহিত একটা দ্বারবানের তুলনা করাও তা, কিন্তু কী করা যায়, কোনো কোনো পাঠকের চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া না দেখাইলে তাহারা বুঝিবেন না। ১. হেমচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য -কর্তৃক অনুবাদিত রামায়ণ। সুন্দর কাণ্ড ।