পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভূতলে অতুল সভা- ফটিকে গঠিত; সরস কমলকুল বিকশিত যথা।। শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত স্তম্ভ সারি সারি ধরে উচ্চ স্বর্ণ ছাদ, ফণীন্দ্ৰ যেমতি, বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে ধরারে। বুলিছে ঝলি ঝালারে মুকুতা, পদ্মরাগ, মরকত, হীরা, যথা ঝোলে । ব্ৰতালয়ে । ইত্যাদি ইহা কি রাবণের সভা? ইহা তো নাট্যশালার বর্ণনা! কতকগুলি পাঠকের আবার পাত্ৰাপাত্র জ্ঞান নাই, তাহারা জিজ্ঞাসা করিবেন। রাবণের সভা মহান করিতেই হইবে তাহার অর্থ কী? না-হয় সুন্দরই হইল, হঁহাদের কথার উত্তর দিতে আমাদের অবকাশ নাই এবং ইচ্ছাও নাই। এককথায় বলিয়া রাখি যে, কবি ব্ৰজাঙ্গনায় যথাসাধ্য রচনায়, বিশেষ রাবণের সভা-বৰ্ণনায় মিষ্টভাবের পরিবর্তে র্তাহার নিকট হইতে আমরা উচ্চ, প্ৰকাণ্ড, গভীর ভাব প্রার্থনা করি। এই সভার বর্ণনা পাঠ করিয়া দেখি রাবণ কঁদিতেছেন, রাবণের রোদনে পুস্তকের প্রারম্ভভাগ যে নষ্ট হইয়া গেল, তাহা আর সুরুচি পাঠকদের বুঝাইয়া দিতে হইবে না। ভালো, এ দোষ পরিহার করিয়া দেখা যাউক, রাবণ কী ভয়ানক শোকেই কঁদিতেছেন ও সে রোদিনই বা কী অসাধারণ; কিন্তু তাহার কিছুই নয়, বীরবাহুর শোকে রাবণ কাঁদিতেছেন। অনেকে কহিবেন, ইহা অপেক্ষা আর শোক কী আছে। কিন্তু তাহারা ভাবিয়া দেখুন, বীরবাহুর পূর্বে রাবণের কত পুত্র হত হইয়াছে, সকল ক্লেশের ন্যায় শোকও অভ্যস্ত হইয়া যায়, এখন দেখা যাউক রাবণের রোদন কী প্রকার। প্ৰকাণ্ড দশানন, কঁদিতেছেন কিরূপে এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি, বাক্যহীন পুত্ৰশোকে! ঝর ঝর ঝরে, অবিরল অশ্রুধারা- তিতিয়া বসনে श्ठानेि রানী মন্দোদরীকে কাদাইতে গেলে ইহা অপেক্ষা অধিক বাক্যব্যয় করিতে হইত না। ইহা পড়িলেই আমাদের মনে হয় গালে হাত দিয়া একটি বিধবা স্ত্রীলোক কঁদিতেছেন। একজন সাধারণ নায়ক এরূপ কঁদিতে বসিলে আমাদের গা জুলিয়া যায়, তাহাতে ইনি মহাকাব্যের নায়ক, যে-সে নায়ক নয়, যিনি বাহুবলে স্বৰ্গপুরী কঁপাইয়াছিলেন, এবং যাঁহার এতদূর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল যে, তাহার চক্ষের উপরে একটি একটি করিয়া পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা নিহত হইল, ঐশ্বৰ্যশালী জনপূর্ণ কনকলঙ্কা ক্রমে ক্ৰমে শ্মশানভূমি হইয়া গেল, অবশেষে যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিলেন তথাপি রামের নিকট নত হন নাই, তাহকে এইরূপ বালিকাটির ন্যায় কাদাইতে বসানো অতি ক্ষুদ্র কবির উপযুক্ত। ভাবুক মাত্রেই স্বীকার করবেন যে, মন্দােদরীই বিলাপ করিতে হইলে Gr হা পুত্ৰ, হা বীরবাহু, বীরচুড়ামণি! কী পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে? কী পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি, হরিলি এ ধন তুই? হায় রে কেমনে সহি এ যাতনা আমি ? কে আর রাখিবে ।