পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য SVG ভাবিলাম মহাকবি সাগরের কী একটি মহান গভীর চিত্ৰই করিবেন, অন্য কোনো কবি এ সুবিধা ছাড়িতেন না। সমুদ্রের গভীর চিত্র দূরে থাক, কবি কহিলেন বহিছে। জলস্রোত কলরবে: স্রোতঃপথে জল যথা বরিষার কালে যাঁহাদের কবি আখ্যা দিতে পারি। তাহদের মধ্যে কেহই এরাপ নীচ বৰ্ণনা করিতে পারেন না, তাহাদের মধ্যে কেহই বিশাল সমুদ্রের ভাব এত ক্ষুদ্র করিয়া ভাবিতে পারেন না। এই স্থলে পুরষ্কার কৌতুহল চরিতার্থকরিবার জন্য রামায়ণ হইতে একটি উৎকৃষ্ট সমূহ বৰ্ণনা উদ্ভূত করিয়া “বিস্তীর্ণ মহাসমূদ্র প্রচণ্ড বায়ুবেগে নিরবচ্ছিন্ন আন্দােলিত হইতেছে। উহার কোথাও উদ্দেশ নাই, চতুর্দিক অবাধে প্রসারিত হইয়া আছে। উহা ঘোর জলজন্তুগণে পূর্ণ প্রদোষকালে অনবরত ফেন বিকাশপূর্বক যেন হাস্য করিতেছে এবং তরঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনপূর্বক যেন নৃত্য করিতেছে। তৎকালে চন্দ্র উদিত হওয়াতে মহাসমুদ্রের জলোচ্ছাস বর্ধিত হইয়াছে এবং প্রতিবিম্বিত চন্দ্ৰ উহার বক্ষে ক্রীড়া করিতেছে। সমুদ্র পাতালের ন্যায় ঘোর গভীরদর্শন, উহার ইতস্ততঃ তিমি তিমিঙ্গিল প্রভৃতি জলজন্তুসকল প্রচণ্ডবেগে সঞ্চরণ করিতেছে। স্থানে স্থানে প্ৰকাণ্ড শৈল; উহা অতলস্পর্শ; ভীম অজগরগণ গর্ভে লীন রহিয়াছে। উহাদের দেহ জ্যোতির্ময়, সাগরবক্ষে যেন অগ্নিচুৰ্ণ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। সমুদ্রের জলরাশি নিরবচ্ছিন্ন উঠিতেছে ও পড়িতেছে। সমুদ্র আকাশতুল্য এবং আকাশ সমুদ্রতুল্য; উভয়ের কিছুমাত্ৰ বৈলক্ষণ্য নাই; আকাশে তারকাবলী এবং সমুদ্রে মুক্তাস্তবক, আকাশে ঘনরাজি এবং সমুদ্রে তরঙ্গাজাল; আকাশে সমুদ্র ও সমুদ্রে আকাশ মিশিয়াছে। প্ৰবল তরঙ্গের পরস্পর সংঘর্ষ নিবন্ধন মহাকাশে মহাভেরীর ন্যায় অনবরত ভীম রব শ্রুত হইতেছে। সমুদ্র যেন অতিমাত্র ক্রুদ্ধ; উহা রোষাভরে যেন উঠিবার চেষ্টা করিতেছে এবং উহার ভীম গভীর রব বায়ুতে মিশ্রিত হইতেছে।” রাবণ সমুদ্রকে সম্বোধন করিয়া যাহা কহিলেন তাহা সুন্দর লাগিল। রাবণ পুনরায় সভায় আসিয়া, শোকে মগ্ন বসিলা নীরবে: বসিলা চৌদিকে, আহা নীরব বিষাদে ! হেনকালে রোদনের মৃদু নিনাদ’ ও কিঙ্কিণীর ‘ঘোর রোল তুলিয়া চিত্রাঙ্গদা আইলেন, কবি তখন একটি ঝড় বাধাইলেন, এই ঝড়ের রূপকটি অতিশয় হাস্যজনক। সুরসুন্দরীর রূপে শোভিল চৌদিকে বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা, ঘন নিশ্বাস প্ৰলয় বায়ু; অশ্রুবারিধারা আসার, জীমূত-মন্দ্ৰ হাহাকার রব। ዕ এই ঝড় উপস্থিত হইতেই অমনি নেত্ৰনীরসিক্ত কিংকরী দূরে চামর ফেলিয়া দিল এবং ছত্রধর ছত্র ফেলিয়া দিয়া কঁদিতে বসিল, আর পাত্ৰ-মিত্ৰ সভাসদ আদি অধীর হইয়া ‘ঘোর কোলাহলে’ কাদিতে লাগিল। রাবণের সভায় এত কান্না তো আর সহ্য হয় না, পাত্ৰ-মিত্ৰ সভাসদ আদিকে এক-একটি খেলেনা দিয়া থামাইতে ইচ্ছা করে। একটু শোকে কিংকরী চামর ছুড়িয়া ফেলিল, একটু শোকে ছত্রধর ছত্র ফেলিয়া কঁদিতে বসিল। একে তো ইহাতে রাজসভার এক অপূর্ব ভাব মনে আসে, দ্বিতীয়ত ক্ৰোধেই চামর আদি দূরে ফেলিয়া দিবার সম্ভাবনা, শোকে বরং হস্ত হইতে অজ্ঞাতে খসিয়া পড়িতে পারে। মহিষী রাবণকে যাহা কহিলেন তাহা ভালো লাগিল, ১ হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য-কর্তৃক অনুবাদিত রামায়ণ। যুদ্ধকাণ্ড, চতুর্থ সর্গ।