পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য , , У еја অদ্যাপি প্ৰজ্বল এত, হেতু সে তাহার। যশোলিলা নহে, পুত্র, অন্য সে লালসা, । নারি ব্যক্ত করিবারে বাক্যে বিন্যাসিয়া। অনন্ত তরঙ্গময় সাগর গর্জন, বেলাগর্ভে দাঁড়াইলে, যথা সুখকর; গভীর শর্বরীযোগে গাঢ় ঘনঘটা, বিদ্যুতে বিদীর্ণ হয়, দেখিলে যে সুখ; কিংবা সে গঙ্গোত্রীপাৰ্থে একাকী দাঁড়ায়ে নিরাখি যখন অম্বুরাশি ঘোর-নাদে পড়িছে পর্বতশৃঙ্গ স্রোতে বিলুঠিয়া, ধরাধার ধরাতল করিয়া কম্পিত! তখন অস্তরে যথা, শরীর পুলকি, দুৰ্জয় উৎসাহে হয় সুখ বিমিশ্রিত; সমরতরঙ্গে পশি, খেলি যদি সদা, সেই সুখ চিত্তে মম হয় রে উখিত। ইহার মধ্যে ভয়ভাবনা কিছুই নাই, বীরোচিত তেজ। মেঘনাদবধ কাব্যে অনেকগুলি ‘প্রভঞ্জন’ ‘কলম্বকুল” প্রভৃতি দীর্ঘপ্রস্থ কথায় সজ্জিত ছত্ৰসমূহ পাঠ করিয়া তোমার মন ভারগ্রস্ত হইয়া যাইবে, কিন্তু এমন ভাবপ্রধান বীরোচিত বাক্য অল্পই খুজিয়া পাইবে। অনেক পাঠকের স্বভাব আছে যে তঁাহারা চরিত্রে চিত্রে কী অভাব কী হীনতা আছে তাহা দেখিবেন না, কথার আড়ম্বরে অশ্রু আকর্ষণ করিলেই তৃপ্ত হন, কিন্তু রাবণের ক্ৰন্দন করা উচিত কি না তাহা দেখিতে চান না, এইজন্যই বঙ্গ-দেশময় মেঘনাদবধের এত সুখ্যাতি। আমরা দেখিতেছি কোনো কোনো পাঠক ভাবিয়া ভাবিয়া মাথা ঘুরাইবেন যে, সমালোচক রাবণকে কেন তাহার কঁদিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে চাহেন ? একজন চিত্রকর একটি কালীর মূর্তি অঙ্কিত করিয়াছিল, আমি সেই মূর্তিটি দেখিয়াছিলাম; পাঠকেরা জানেন পুরাণে কালীর কীরূপ ভীষণ চিত্রই অঙ্কিত আছে, অমাবস্যার অন্ধকার নিশীথে যাহার পূজা হয়, আলুলিত কুন্তলে বিকট হাস্যে যিনি শ্মশানভূমিতে নৃত্য করেন, নরমুণ্ডমালা যাহার ভূষণ, ডাকিনী যোগিনীগণ যাহার সঙ্গিনী, এমন কালীর চিত্ৰ । আঁকিয়া চিত্রকর তাঁহাকে আপাদমস্তক স্বর্ণালংকারে বিভূষিত করিয়াছে, অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তি এই চিত্রটির বড়োই প্রশংসা করিয়াছিলেন, যাঁহারা সংহারশক্তিরূপিণী কালিকার স্বর্ণভূষণে কোনো দোষ দেখিতে পান না তাহারা রাবণের ক্ৰন্দনে কী দোষ আছে ভাবিয়া পাইবেন না, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাহাদের জন্য এই সমালোচনা লিখিত হইতেছে না। মূল কথা এই বঙ্গদেশে এখন এমনই সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞানদর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল-ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলী মুখস্থ করিতে । পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাতে তাঁহাদের রুচিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই। বাল্মীকির রামায়ণে শোকের সময় রাবণের কীরূপ অবস্থা বর্ণিত আছে, এ স্থলে তাহা অনুবাদ করিয়া পাঠকদের গোচরার্থে লিখিলাম, ইহাতে পাঠকেরা দেখিবেন বাল্মীকির রাবণ হইতে মেঘনাদবধের রাবণের কত বিভিন্নতা। অনন্তর হনুমানৰুর্ভুক অক্ষ নিহত হইলে রাক্ষসাধিপতি মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করিয়া ইন্দ্ৰজিৎকে রণে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করার ১. সুন্দরকাণ্ড, ৪৩ অধ্যায়। ২. যুদ্ধকাণ্ড, ২৯ অধ্যায়। ৩. যুদ্ধকাণ্ড, ৩১ অধ্যায়।