পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२०२ রবীন্দ্র-রচনাবলী গেটে ও র্তাহার প্রণয়িনীগণ গেটের বোধ হয় বিশেষ পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। যিনি জার্মান-সাহিত্যের অহংকার ও অলংকারস্বরূপ, যিনি ‘ফস্ট” নামক নাটক লিখিয়া মানব হৃদয়ের সূক্ষ্মতম শিরা পর্যন্ত কঁপাইয়া তুলিয়াছিলেন, যিনিই প্রথমে যুরোপমণ্ডলে আমাদের শকুন্তলার আদর বর্ধিত করিয়াছিলেন, তার নূতন পরিচয় কী দিব?— কিন্তু তিনি অদ্বিতীয়রূপে সূক্ষ্মদশী ও বহুদশী হইয়াও জীবনে কতদূর দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিলেন তাহা দেখাইবার জন্য পাঠকদের সম্মুখে তাহার প্রেম-কাহিনী আজ উদঘাটিত করিতেছি— গেটে তাহার পঞ্চদশ বৎসর বয়স হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ভালোবাসিয়া আসিয়াছেন, অথচ বিয়াত্ৰিচে বা লরার ন্যায় তাহার একটি প্ৰণয়িনীরও নাম করিতে পারিলাম না। দান্তে ও পিত্রার্কার প্ৰেম প্রেমের আদর্শ, আর গেটের প্ৰেম পার্থিব অর্থাৎ সাধারণ। শুদ্ধ যে গেটের দুর্বল প্ৰেম নিরাশা ও উপেক্ষা সহিয়াই স্থির থাকিতে পারে না এমন নহে, সে প্রেমের স্বভাব এই যে, তাহার আশা পূর্ণ হইলেই সে আর থাকিতে পারে না। গেটের প্রেম এক দ্বারে নিরাশ হইলে অমনি আর-এক দ্বারে যাইত, আবার আশা পূর্ণ হইলেও থাকিত না। গেটের পক্ষে আশাপূর্ণতা ও নৈরাশ্য উভয়ই সমান কার্যকরিত; এ প্রেমের উপায় কী? গেটের জীবনে এক-একটি প্ৰেমআখ্যান শেষ হইলে, অমনি তাহা লইয়া তিনি নাটক রচনা করিতেন, দান্তে বা পিত্রার্কার ন্যায় কবিতা লিখিতেন না। বাস্তব ঘটনাই নাটকের প্রাণ, আদর্শ জগৎই কবিতার বিলাসভূমি। যাহা হইয়া থাকে, নাটককারেরা তাহাঙ্গলক্ষ করেন- যাহা হওয়া উচিত কবিদের চক্ষে তাহাই প্ৰতিভাত হয়। গেটে তাহার নিজের প্ৰেম নাটকে গ্রথিত করিতে পারিতেন, সাধারণ লোকেরা তাহাতে তাহার নিজ-হৃদয়ের আভাস পাইত। কিন্তু বিয়াত্ৰিচের প্রতি-অভিবাদনে, দাস্তের হৃদয়ে যে কাহারও মুখে সাজিত না। গেটে কাহেন, বাল্যকালে তিনি ফুলের পাপড়ি ছিড়িয়া দেখিতেন তাহা কীরূপে সজ্জিত আছে- পাখির পালক ছিড়িয়া ছিড়িয়া দেখিতেন তাহা ডানার উপর কীরূপে গ্রথিত আছে। বেটিনা তাহার প্রণয়িনীদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, রমণীর হৃদয় লইয়াও গেটে সেইরূপ করিয়া দেখিতেন। তিনি তাহাদের প্রেম উদ্রেক করিতেন- এবং প্রেম-কাহিনী সর্বাঙ্গসুন্দর করিবার জন্য কল্পনার সাহায্যে নিজেও কিয়ৎপরিমাণে প্ৰেম অনুভব করিতেন, কিন্তু সে প্রেম তাহার ইচ্ছাধীন, প্রয়োজন অতীত হইলেই সে প্রেম দূর করিতে র্তাহার বড়ো একটা কষ্ট পাইতে হয় নাই। গেটে নিজেই কহেন, যদি বা প্রেম লইয়া তাহার হৃদয়ে কখনাে আঘাত লাগিত, সে বিষয়ে একটি নাটক লিখিলেই সমস্ত চুকিয়া যাইত। যতখানি পর্যন্ত ভালোবাসিলে কোনো আশঙ্কার সম্ভাবনা নাই, গোটে ততখানি পর্যন্ত ভালোবাসিতেন, তাহার উদ্ধের্ব আর নহে। বাল্যকাল হইতেই গেটের সকল শ্রেণীর লোকদের রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিবার ভাব ছিল। এই কারণে তিনি এক-এক সময় অত্যন্ত নীচ শ্রেণীর লোকদের সহিত মিশিতেন। তিনি পঞ্চদশ বৎসর বয়সে একবার এইরূপ এক শ্রেণীর লোকদের মধ্যে একটি রাত্রিভোজে উপস্থিত ছিলেন। অভ্যাগতগণ বার বার মদ্য প্রার্থনা করিলে দাসীর পরিবর্তে একটি বালিকা ১. ম্যানফ্রেডের সমালোচনায় গেটে লিখিয়াছেন যে, বাইরন ফ্লোরেন্সে এক বিবাহিতা মহিলার প্রেমে পড়েন, কিন্তু এই প্রেমবৃত্তািড় জানিতে পারিয়া স্বামী আপনি স্ত্রীকে হত্যা করে, কিন্তু সেই রাত্রেই বিছানার উপরে তাহারও মৃতদেহ দৃষ্ট হয়, বাইরন সেই রাত্রেই ফ্লোরেন্স ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। ম্যানফ্রেডে যে রমণীর প্ৰেতাত্মার কথা বর্ণিত আছে সে পূর্বোক্ত মহিলা। গেটে লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু এ গল্পটির কোনো মূল্য নাই, সম্পূর্ণ কাল্পনিক। গেটে নিজের সাদৃশ্য মনে করিয়াছিলেন, বাইরনও আপনার জীবনের ঘটনা হইতেই উক্ত নাটক লিখিয়া থাকিবেন।