পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অনুসন্ধান করিতে বলিলেন। এই মনোবেদনায় গেটে অত্যন্ত পীড়িত হইলেন, এমন-কি, তাহার মস্তিষ্কের পীড়া জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল। তিনি গ্রেশেন ও তাহার বন্ধুদের ভাবনায় অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তিনি তাহার বন্ধুকে গ্রেশেনের বার্তা জিজ্ঞাসা করিলেন- বন্ধুটি ঘাড় নাড়িয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন- “সে বিষয়ে তোমার বড়ো একটা ভাবিতে হইবে না- সে কিছুমাত্র বিচলিত হয় নাই; সে দিব্য স্বচ্ছন্দে বাস করিতেছে।” সে স্পষ্টই স্বীকার করিল যে, হাঁ আমি তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছি বটে, এবং দেখিয়া আনন্দ লাভ করিয়াছি- কিন্তু সর্বদাই বালকটির ন্যায় তাহার প্রতি আমি ব্যবহার করিতাম- আর আমার তাহার প্রতি ভগিনীর মতো ভালোবাসা ছিল।” এইরূপে অতি গভীরা-গৃহিণী-ভাবে গ্রেশেন যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার বন্ধু সমস্ত বলিয়া যাইতে লাগিলেন। কিন্তু শেষ কথাগুলি আর গেটে শুনিলেন না- গ্রেশেন যে তাহাকে ক্ষুদ্র বালকটি মনে করিত তাঁহাই তাহার প্রাণে বিধিয়া গেল। ও কথাটা তাহার বড়োই খারাপ লাগিল— তিনি মনে মনে স্থির করিলেন, গ্রেশেনের উপর হইতে র্তাহার সমস্ত ভালোবাসা চলিয়া গিয়াছে। তিনি তাহার বন্ধুকে স্পষ্টই বলিলেন, এখন হইতে সমস্তই চুকিয়া বুকিয়া গেল। গেটে গ্রেশেনের কোনো সম্পর্কে আর রহিলেন না- তাহার নামোল্লেখ পর্যন্ত করিতেন না। এমন-কি, পূর্বে তিনি তাহার মুখশ্ৰী যেরূপ চক্ষে দেখিতেন, এখন তাহা বিপরীতভাবে দেখিতে লাগিলেন- এতদিনে তাহার যথার্থ ভাব বুঝিতে পারিলেন-- তাহার মমতাশূন্য নীরস মুখশ্ৰী তাঁহার চক্ষে পরিস্ফুট হইল। কিন্তু হৃদয়ের আঘাত যন্ত্রণা শীঘ্র নিবৃত্ত হইবার নহে। তিনি কহিলেন- "যে-সকল বন্ধুদের ব্যবহারে স্পষ্টই বোধ হয়, তোমার চরিত্র তাহারা সংশোধন করিতে চাহিতেছে তাহাদের দ্বারা কোনো ফল জন্মে না- একজন স্ত্রীলোক যাহার ব্যবহারে সহসা মনে হইতে পারে সে তোমাকে নষ্ট করিতেছে সেই স্ত্রীলোকই অলক্ষিতভাবে তোমার চরিত্র সংশোধন করে।” তিনি তাহার লিখিত উপাখ্যানের এক স্থানে লিখিয়াছেন— ‘কুমারীরা অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক বালকদের অপেক্ষা আপনাকে মহা বিজ্ঞ মনে করে- আর তাহাদিগকে প্ৰথমে যে বেচারী ভালোবাসা জানায়- তাহাদের নিকট তাহারা মহা দিদিমার চালে চলিতে থাকে।” এ কথাটা সত্য- এবং অনেক অশ্রুজিলের মধ্য হইতে তিনি এ সত্যটি উপার্জন করিয়াছিলেন। গেটের প্রেম বহুদিন অলস ও নিষ্কর্ম হইয়া বসিয়া থাকে নাই— অ্যানসেন নামক আর-একটি সুশ্ৰী বালিকা তাহার হৃদয় অধিকার করিল। গেটের এইবারকার প্ৰেম-কাহিনীতে আমরা প্রেমের আর-এক মূর্তি দেখিতে পাইব। অ্যানসেন অল্পবয়স্ক, সুন্দরী, প্ৰফুল্প এবং প্রিয়দর্শন ছিল। গোেট স্বীয় মোহিনী শক্তির বলে তাহার প্ৰেম আকর্ষণ করিয়াছিলেন, এবং সে প্ৰেমকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়াছিলেন। কিন্তু তেমনি গেটে সে বালিকার প্রেমের উপর অত্যন্ত অন্যায় ব্যবহার করিতেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন- যে কারণেই হােক তাহার মন খারাপ হইলেই তিনি সেই বেচারীর উপরে আক্রোশ প্রকাশ করিতেন- কেন? না সে প্ৰাণপণে র্তাহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করিত বলিয়া। তাহাকে সন্তুষ্ট রাখা তাহার ব্রত ছিল, এই সুমহৎ অপরাধে তিনি তাহার প্রতি ক্ৰমাগত অসন্তোষ প্রকাশ । করিতেন! অনৰ্থক অসূয়া ও অকারণ সন্দেহে তিনি আপনাকে ও তাঁহাকে সর্বদাই অসুখী করিতেন। এই সকল প্ৰণয়ের অত্যাচার অ্যানসেন অনেকদিন পর্যন্ত সহ্য করিয়াছিল, প্রশংসনীয় ধৈর্যের সহিত সহ্য করিয়াছিল; কিন্তু আর সহিল না। ক্রমাগত জ্বালাতন হইয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাতের পর আঘাত পাইয়া অবশেষে তাহার ধৈর্য টুটিয়া গেল। অন্যায় অত্যাচারে তাহার প্রেম ক্ৰমে ক্রমে বিনষ্ট হইয়া গেল। এদিকে গেটে তাহাকে সত্য সত্য মনের সহিত ভালোবাসিতেন। অ্যানসেন যখন বিমুখ হইয়া দাঁড়াইল তখন গেটের চৈতন্য জন্মিল। এতদিন অ্যানসেন তঁহাকে সাধিয়া আসিতেছিল, এখন তাঁহার সাধিবার পালা পড়িল। তিনি তাহার প্ৰেম পুনজীবিত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু আর হয় না, অ্যানসেনের মন আর ফিরিবার নহে, একেবারে তাহার উপর হইতে তাহার প্ৰেম চলিয়া গিয়াছে। কিছুদিন পরে অ্যানসেনের বাসভূমি