পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NRR রবীন্দ্র-রচনাবলী শুনিব শিখরে বসি পাখি গায় গান, তটিনী শবদ সাথে মিশাইয়া তান; রাখাল গোরুর পাল চরাইয়া ফিরে। রচি দিব গোলাপের শয্যা মনোমতো; সুরভি ফুলের তোড়া দিব কত শত; গড়িব ফুলের টুপি পরিবি মাথায়, আঙিয়া রচিয়া দিব গাছের পাতায়। লয়ে মেষ শিশুদের কোমল পশম সুন্দর পাদুকা এক করিয়া রচিত, খাটি সোনা দিয়ে তাহা করিব খচিত। কটি-বন্ধ গড়ি দিব গাঁথি তৃণ-জাল, মাঝেতে বসায়ে দিব একটি প্রবাল । এই সব সুখ যদি তোর মনে ধরে হ আমার প্ৰিয়তমা, আয় মোর ঘরে। হস্তি-দন্তে গড়া এক আসনের পরে, আহার আনিয়া দিবে দুজনের তরে, দেবতার উপভোগ্য, মহার্ঘ। এমন, রজতের পাত্রে দেহে করিব ভোজন। রাখাল-বালক যত মিলি একত্তরে নাচিবে গাইবে তোর আমোদের তরে। এই সব সুখ যদি মনে ধরে তব, হ আমার প্ৰিয়তমা, এক সাথে রব। এ কবিতাতে একটি বিশেষ ভাবকে সমগ্র রাখা হয় নাই। মাঝখানে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। যে বিশাল কল্পনায় একটি ভাব সমগ্ৰ প্ৰতিবিম্বিত হয়, যাহাতে জোড়াতাড়া দিতে হয় না, সে কল্পনা ইহাতে প্রকাশিত হয় নাই। কিয়দূর পর্যন্ত একটা ভাব সম্পূর্ণ রহিয়াছে, তাহার পরে আর-একটি ভাব গাঁথিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু দুই ভাবের মধ্যে এমন অসামঞ্জস্য যে, উভয়ে পাশাপাশি ঘেসাঘেসি থাকিয়াও উভয়ের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে, উভয়েই ভাবিতেছে, এ এখানে কেন ? পরস্পরের মধ্যে গলাগলি ভাব নাই। অরণ্য, পর্বত, প্রাস্তরে যত কিছু সুখ পাওয়া যায়, তাহাই যে রাখালের আয়ত্তাধীন, যে ব্যক্তি গোলাপের শয্যা ফুলের টুপি ও পাতায় আঙিয়া নির্মাণ করিয়া দিবার লোভ দেখাইতেছে সে স্বর্ণখচিত পাদুকা, রাজতের পাত্ৰ, হস্তি-দস্তের আসন পাইবে কোথায়? তৃণ-নির্মিত কািটবন্ধের মধ্যে কি প্রবাল শোভা পায়? আমাদের পাঠকদের মধ্যে যে কেহ কখনো কবিতা লিখিয়াছেন, সকলেই বলিয়া উঠিবেন, আমি হইলে এরূপ লিখিতাম না। সে কথা আমি বিশ্বাস করি। তাহার অর্থ আর কিছুই নহে, তাহারা শিক্ষা পাইয়াছেন। কবিতা রচনায় তাহারা হয়তো আমন একটা জাজ্জ্বল্যমান দোষ করেন না, কিন্তু ওই শ্রেণীর দোষ সচরাচর করিয়া থাকেন। যাহারা বাস্তবিক কবি, অন্তরে অন্তরে কবি, তাহারা এরূপ দােষ করেন না; কিসের সহিত কিসের ঐক্য অনৈক্য আছে তাহা তাহারা অতি সূক্ষ্মরূপে দেখিতে পান।