পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

yo রবীন্দ্ৰ-রচনাবলীܘܓ বাড়ি গড়িতে হইবে কিন্তু তাহার আগে শূন্যের উপর সে বাড়ি না। গড়িলে চলে কি? যদি কাজের বাড়ি গড়িবার পূর্বে কল্পনার বাড়ি গড়া নিতান্তই আবশ্যক, তবে কল্পনার বাড়ি যত পরিষ্কার ও ভালো করিয়া গড় কাজের বাড়িও তত ভালো হইবে সন্দেহ নাই। কল্পনার ভিত্তিতে বাড়ি যদি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ না হয় তবে মাটির উপর গড়িতে তাহা পাঁচবার করিয়া ভাঙিতে হইবে।” অতএব দেখা যাইতেছে যে, কল্পনা কাজের বাধাজনক নহে বরঞ্চ শ্ৰীবৃদ্ধিসাধক। তবে কেন কল্পনার নামে অনৰ্থক এরূপ একটা বদনাম হইল ? বোধ হয় তাহার কারণ এই যে, যাহারা । নিত্যনিয়মিত ধরাবাঁধা কাজ করে, যে কাজে একটা যন্ত্রের অপেক্ষা অধিক বুদ্ধি থাকিবার আবশ্যক করে না, কালও যাহা করিয়াছিলাম আজও তাহা করিতেছি, আর কালও তাঁহাই করিতে হইবে, তাহাদের কল্পনা খোরাক না পাইয়া অত্যন্ত ত্ৰিয়মাণ হইয়া পড়ে। এবং যাহাদের কল্পনা অধিক, তাহারা এরূপ কাজ করিতে সম্মত হয় না। তাহারা এমন কাজ করিতে চায় যাহাতে কিছু সৃষ্টি করিবার আছে, ভাবিবার আছে। একজন কাল্পনিক পুত্রকে যখন তাহার পিতা কহেন “ইহার কিছু হইবে না।” তখন তাহার কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এ হতভাগ্যের পুত্র কেরানি হইতে পরিবে না বা হিসাব রাখিবার সরকার হইতে পরিবে না। কিন্তু একটা মহান কাজ মাত্রেই কল্পনার আবশ্যক করে তাহা বলাই বাহুল্য। নিউটন বা নেপলিয়নের কল্পনা কি সাধারণ ছিল ? ইংলন্ডের লোকেরা কাজের লোক! এ কথা সত্য বটে কাজের লোক বলিতে বুঝায় যে তাহার মধ্যে অধিকাংশই চিঠি কপি করা হিসাব রাখা প্রভৃতি ধরাবাঁধা কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাহা হইতে কি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়? যে দেশে যন্ত্রের বাহুল্য সে দেশে যন্ত্রীর বাহুল্য। একজন বা দুই জন বা কতকগুলি লোকে মিলিয়া একটা প্ৰকাণ্ড কাজের সৃজন ও স্থাপন করে ও তাঁহাতেই দশ জনে মিলিয়া খাটে। অন্ধকারে যদি কেবল দেখিতে পাও যে, দুইটি হাত ভারি কাজে ব্যস্ত আছে, তৎক্ষণাৎ জানিবে কাছাকাছি একটা মস্তক আছে। যে শরীরের মাথা নাই, সে শরীরের হাতে কোনো কাজ থাকে না। ইংলন্ডে অত্যন্ত কাজের ভিড় পড়িয়াছে, তাহা হইতে প্ৰমাণ হইতেছে ইংলন্ডের মাথা আছে। যখন তুমি দেখা যে শরীরের অধিকাংশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না ভাবিয়া যন্ত্রের মতো কাজ করে, পা চলিতেছে কিন্তু পায়ের ভিতরে মস্তিষ্ক নাই, পা ভাবিয়া চিন্তিয়া চলে না, অন্যান্য প্রায় সকল অঙ্গই সেইরূপ, যখন তুমি মনে কর না যে সে শরীরটায় মস্তিষ্ক নাই। একজন ব্যক্তির কল্পনা আছে বলিয়া দশ জন অকাল্পনিক লোক কাজ পায়। ইংলন্ডে যে এত কাজ দেখিতেছি তাহার অর্থ ইংলন্ডে অনেক কাল্পনিক লোক আছে। একজন দরিদ্র ইংরাজ যে তাহার স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া অতি দূরদেশে গিয়া ধন সঞ্চয় করিয়া সম্পক্তিশালী হইয়া উঠে তাহার

  • অনেকে ভুল বুঝিতে আশ্চর্যরূপে পটু। তঁহাদের ধন্য বলিতে হইবে। তঁহাদের যদি বলা যায় যে, কামানের গোলা লাগিলে মানুষ মরিয়া যায়, তাহারা তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠেন, “বিলক্ষণ! এই সেদিন দেখিলাম সাতকড়ি সার্বভৌম মহাশয়ের লোকান্তর প্রাপ্তি হইল,কিন্তু বিশ ক্রোশের মধ্যে একটি কামান ছিলনা!” এত ক্ৰোধ যে, তোমাকে মিথ্যাবাদী বলিয়ামারিতে উদ্যত তীহাদের বলা গেল যে, কবি হইতে গেলে শিক্ষার আবশ্যক, তাহারা বলিলেন “কই, শিক্ষিত ব্যক্তিরা তো কবি হয় না!”তীহাদের প্রতি লেখকের এই নিবেদন যে, যখন তঁহাদের বলা হয় যে, “আগুনের উপরনাচড়াইলে পায়স প্রস্তুত হয় না।” তখন তাহারা মনোনা করিয়া বসেন যে, আগুনের উপর জলচড়াইলেও পায়স প্রস্তুত হয়। বক্তার এই বলা অভিপ্রায় যে, আগুনের উপর দুধ ও চাল চড়াইলেই তবে পায়স হয়। বক্তা জানিতেন যে, যাহাকে বলা হইতেছে সে জানে কী কী পদার্থে পায়স প্রস্তুত হয়, কেবল জানে না যে, আগুনের উপর চড়ানাে পায়স প্রস্তুত করণের একটা অঙ্গ। যাহার কবিত্ব আছে শিক্ষায় সেই কবি হয়। বর্তমান লেখক যাঁহাদের জন্য এই প্রবন্ধ লিখিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, কবির কল্পনা থাকা নিতান্ত আবশ্যক, কেবল তাহারা অস্বীকার করেন যে, কবির প্রকাশক্ষমতা ও শিক্ষার আবশ্যক.এইজন্য কল্পনার বিষয়ে কিছুই বাহুল্য উল্লেখ করা হয়নি। যাহা হউক, উপরি-উক্ত শ্রেণীর পাঠকদিগের জন্য কি এমন একটি বাহুল্য কথা বলিতে হইবে যে, কল্পনা থাকিলেই যে, ভালো বাড়ি গড়া হয় তাহা নহে; দুই সমশ্রেণীর কারিগরের মধ্যে যাহার কল্পনা অধিক সেই অপরের অপেক্ষা ভালো বাড়ি গড়িবে!