পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Nq8 S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তবে তাঁহাতে কোনো উদ্দেশ্যই ভালো করিয়া সাধিত হয় না; না সমস্তটার ভালো ছবি পাওয়া যায়, না এক অংশের ভালো ছবি পাওয়া যায়। এইজন্যই লেখক-চিত্রকরদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, যে যে-ভাবটাকে কাছে দেখিতেছি, তাহাঁই বড়ো করিয়া আঁকো; ভাবিয়া চিন্তিয়া, বিচার কোনো আবশ্যক নাই। : h “দেশজ প্রাচীন কবি ও আধুনিক কবি” নামক প্রবন্ধের লেখক এক দিক হইতে ছবি আঁকিয়া তাহার নিকটের দিকটাকেই বড়ো করিয়া দেখাইয়াছেন;- আবার বিপরীত দিকটাও দেখানো আবশ্যক। কবিতায় কৃত্রিমতা দোষােহাঁ, এ বিষয়ে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না। কিন্তু যখন লেখক এই সাধারণ মত ব্যক্ত না করিয়া কতকগুলি বিশেষ মতের অবতারণা করিয়াছেন, তখনই তাহার সহিত আমাদের মতান্তর উপস্থিত হয়। যখন তিনি বলেন, দেশকালপত্র-বহির্ভূত হইলে কবিতা কৃত্রিম হয় ও আধুনিক বঙ্গীয় কবিতা দেশকালপত্র-বহির্ভূত হইতেছে, সুতরাং কৃত্রিম হইতেছে, তখনই তাহার সহিত আমরা সায় দিতে পারি না। : “দেশকলপাত্ৰ” কথাটাই একটা প্ৰকাণ্ড ভাঙা কুলা- উহার উপর দিয়া অনেক ছাই ফেলা গিয়াছে। কোনো বিষয়ে কোনো পরিবর্তন দেখিয়া ব্যক্তি বিশেষের তাহা খারাপ লাগিলেই তৎক্ষণাৎ তিনি দেশকলপাত্রের দোহাই দিয়া তাহার নিন্দা করিয়া থাকেন। যখন কোনো যুক্তিই নাই, তখনাে দেশকলপাত্র মাটি কামড়াইয়া আছে। যাহারা দেশকলপাত্রের দোহাই দিয়া কোনো পরিবর্তনের সম্বন্ধে আপত্তি করিয়া থাকেন, র্তাহারাই হয়তো নিজের যুক্তিতে নিজে মারা পড়েন। দেশকালপাত্রের কিছু হাত-পা নাই— · তাহাকে ধরিবার ছুইবার কোনো উপায় নাই। টলেমি দেশকলপাত্রের নাম করিয়া ঋতু পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীকে অনায়াসেই ভৎসনা করিতে পারেন, কিন্তু গ্যালিলিও বলিবেন যে আমরা এত ক্ষুদ্র ও পৃথিবী এত বৃহৎ, যে, পৃথিবী যে চলিতেছে, পৃথিবী যে একস্থানে দাঁড়াইয়া নাই। ইহা আমরা জানিতেই পারি না; বাস্তবিকই যদি পৃথিবী না চলিত, তবে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন ঘটিবেই বা কেন ? তেমনি সমাজ-সংস্কার-বিরোধীরা কোনো একটি পরিবর্তন দেখিয়া যখন অন্য তখন তঁহাদের বিরোধীপক্ষীয়েরা অনায়াসেই বলিতে পারেন যে, দেশকলপাত্রের যে পরিবর্তন জুলাই, তাহা তােমাকে কে বললঃ তাহাই যদি না হইবে, তবে কি এ পরিবর্তন মূলেই ঘটিতে SN P লেখক বলিতেছেন- আমাদের আধুনিক কবিরা দেশকলপাত্রের ব্যভিচার করিয়া কবিতা লেখেন। কী তাহার প্রমাণ ? না আমাদের প্রাচীন কবিরা যেভাবে কবিতা লিখিতেন, এখনকার কবিরা সেভাবে কবিতা লেখেন না, কথাটা যদি সত্য হয় তবে তাহা হইতে কি ইহাই প্রমাণ হইতেছে না যে, বাস্তবিকই দেশকলপাত্রের পরিবর্তন হইয়াছেঃ নহিলে, কখনােই লেখার এরূপ পরিবর্তন ঘটিতেই পারিত না। অতএব লেখক যদি বলেন, যে, প্রাচীন কবিরা যেরূপ লিখিতেন, আমাদেরও সেইরূপ লেখা উচিত— তাহা হইলে আর-এক কথায় এই বলা হয় যে, দেশকলপাত্রের ব্যভিচার করিয়াই কবিতা লেখা উচিত। ইংরাজি পড়িয়াই হউক, আর যেমন করিয়াই হউক, আমাদের মনের যে পরিবর্তন হইয়াছে সে নিশ্চয়ই। একবার লেখক বিবেচনা করিয়া দেখুন দেখি- তিনি যে প্ৰবন্ধটি লিখিয়াছেন, তাহার ভাষা-বিন্যাস, তাহার ভাব-ভঙ্গি, তাহার রচনা প্ৰণালী, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেকার বাংলা হইতে কত তফাত। তাহার প্রবন্ধটির অস্থিমজ্জায় ইংরাজি শিক্ষার ফল প্রকাশ পাইতেছে কি না, একবার মনোযোগ দিয়া দেখুন দেখি! অতএব, এই উপলক্ষে আমি কি বলিতে পারি যে, লেখক কষ্ট করিয়া মেহন্নত করিয়া একটি ইংরাজি আদর্শ অবিরাম চক্ষের সম্মুখে খাড়া রাখিয়া উল্লিখিত