পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Հ8N9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রাথচক্ৰ আঁকিতে চাও তবে তাহার প্রত্যেক অর স্পষ্ট আঁকিয়া দিতে হইবে, কিন্তু যখন তাহার ঘূৰ্ণগতি আঁকিতে হইবে, তাহার বেগ আঁকিতে হইবে, তখন অরগুলিকে ধ্রুয়ার মতো করিয়া দিতে হইবে- ইহার অন্য উপায় নাই। সে সময়ে যদি হঠাৎ আবদার করিয়া বস। আমি ধুয়া দেখিতে চাহি না, আমি অরগুলিকে স্পষ্ট দেখিতে চাই, তবে চিত্রকরকে হার মানিতে হয়। ভবভূতি ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভাবের আবেগ প্রকাশ করিতে গিয়াই বলিয়াছেন। ‘সুখমিতি বা দুঃখমিতি বা’। নাহিলে স্পষ্ট কথায় সুখকে সুখ বলাই ভালো তাহার আর সন্দহ নাই। বলরামদাস লিখিয়াছেন আধা চরণে আধা চলনি, আধ মধুর হাস। ইহাতে যে কেবল ভাষার অস্পষ্টতা তাহা নহে, অর্থের দোষ। ‘আধা চরণ’ অর্থ কী? কেবল পায়ের আধখানা অংশ? বাকি আধখানা না চলিলে সে আধখানা চলে কী উপায়ে! একে তো আধখানি চলনি, আধখানি হাসি, তাহাতে আবার আধখানা চরণ! এগুলো পুরা করিয়া না দিলে এ কবিতা হয়তো অনেকের কাছে অসম্পূর্ণ ঠেকিতে পারে। কিন্তু যে যা বলে বলুক, উপরিউদধূত দুটি পদে পরিবর্তন চলে না। ‘আধ চরণে আধা চলনি’ বলিলে ভাবুকের মনে যে একপ্রকার চলন সুস্পষ্ট হইয়া উঠে, ভাষা ইহা অপেক্ষা স্পষ্ট করিলে সেরূপ সম্ভবে না। অত্যন্ত স্পষ্ট কবিতা নিহিলে যাহারা বুঝিতে পারেন না তাহারা স্পষ্ট কবিতার একটি নমুনা দিয়াছেন। তঁহাদের ভূমিকা-সমেত উদধূত করি। “বাংলার মঙ্গল-কাব্যগুলিও জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা। কবিকঙ্কণের দারিদ্র্য-দুঃখ-বৰ্ণনা- যে কখনো দুঃখের মুখ দেখে নাই তাহাকেও দীনহীনের কষ্টের কথা বুঝাইয়া দেয়। দুঃখ করো অবধান, দুঃখ করো অবধান আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান।” এই দুইটি পদের ভাষ্য করিয়া লেখক বলিয়াছেন, "ইহাই সার্থক কবিত্ব; সার্থক কল্পনা; সার্থক প্রতিভা।” পড়িয়া সহসা মনে হয় এ কথাগুলি হয় গোঁড়ামি, না-হয় তর্কের মুখে অত্যুক্তি। আমানি খাবার গর্ত দেখাইয়া দারিদ্র্য সপ্রমাণ করার মধ্যে কতকটা নাট্যনৈপুণ্য থাকিতেও পারে, কিন্তু ইহার মধ্যে কাব্যরস কোথায়? দুটাে ছত্র, কবিত্বে সিক্ত হইয়া উঠে নাই; ইহার মধ্যে অনেকখানি আমনি আছে, কিন্তু কবির অশ্রুজল নাই। ইহাই যদি সার্থক কবিত্ব হয় তবে “তুমি খাও ভাড়ে জল আমি খাই ঘাটে”, সে তো আরও কবিত্ব। ইহার ব্যাখ্যা এবং তার ভাষ্য করিতে গেলে হয়তো ভাষ্যকারের করুণরস উদবেলিত হইয়া উঠিতেও পারে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও সকলেই আর-কোনো নাম দিন। যিনি ভঙ্গি করিয়া কথা কহেন তিনি না-হয় ইহাকে কাবু বলুন, শুনিয়া দৈবাৎ কাহারও হাসি পাইতেও পারে। প্রকৃতির নিয়ম-অনুসারে কবিতা কোথাও স্পষ্ট কোথাও অস্পষ্ট, সম্পাদক এবং সমালোচকেরা তাহার বিরুদ্ধে দরখাস্ত এবং আন্দোলন করিলেও তাহার ব্যতিক্রম হইবার জো নাই। চিত্রেও যেমন কাব্যেও তেমনই- দূর অস্পষ্ট, নিকট স্পষ্ট; বেগ অস্পষ্ট, আচলতা স্পষ্ট; মিশ্রণ অস্পষ্ট, স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। আগাগোড়া সমস্তই স্পষ্ট, সমস্তই পরিষ্কার, সে কেবল ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে থাকিতে পারে; কিন্তু প্ৰকৃতিতেও নাই, কাব্যেও নাই। অতএব ভাবুকেরা স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট লইয়া বিবাদ করেন না, তাহারা কাব্যরসের প্রতি মনোযোগ করেন। “আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান” ইহা স্পষ্ট বটে, কিন্তু কাব্য নহে। কিন্তু বিদ্যাপতির সখি, এ ভরা বান্দর, মাহ ভাদর স্পষ্টও বটে কাব্যও বটে। ইহা কেবল বর্ণনা বা কথার কথা মাত্র নহে, কেবল একটুকু পরিষ্কার