পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য SV6 নিপুণতা লাভ করিতেন? তেমনি জীবন্ত সাহিত্যের প্রাণশক্তি যেখানে বর্তমান থাকিয়া কাৰ্য করিতেছে সেইখানে সংলগ্নভাবে থাকিলে তবেই যথার্থ অন্তরের মধ্যে সেই অভ্রান্ত সাহিত্যঅভিজ্ঞতা লাভ করা যায় ও সমালোচনা করিবার ক্ষমতা জন্মে। তখন আর পুথি মিলাইয়া কাজ করিতে হয় না, তখন আর তর্জমা করিয়া পরখ করিতে হয় না, তখন নুতন সৃষ্টি নূতন সৌন্দর্য দেখিলে অগাধ সমুদ্রে পড়িতে হয় না, তখন কল্পনারাজ্যের নূতন পুরাতন সকলেরই সহিত চক্ষের নিমেষে কী এক মন্ত্রের বলে পরিচয় হইয়া যায়। ২৪ ৩ ৯০ (অ্যাজ সু। [[রেনরা ] সোলাপুর যাচ্ছে)- পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক [ ১২ চৈত্র ১২৯৬] [ কাব্য ] মীমাংসা হয় না। এ সম্বন্ধে আমার মত আমি সংগীত ও কবিতা নামক প্ৰবন্ধে বাল্যকালে লিখিয়ছিলাম, এই খাতায় সংক্ষেপে তাঁহারই পুনরুক্তি করিতে বসিলাম। ... এইখানে আমি এমন একটা কথা বলিতে চাহি যাহা শুনিতে অত্যন্ত বাস্পময় কাল্পনিক মনে হইতে পারে। কিন্তু যাহা আমি একান্ত প্রকৃত সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি।— জগতের সমস্ত বিষয়ের মধ্যেই অসীমতা আছে; যাহাকে আমরা সুন্দর বলিয়া অনুভব করি এবং ভালোবাসি, তাহার মধ্যেই সেই অসীমতা আমরা কিয়ৎ পরিমাণে উপভোগ করিতে পারি। অতএব কোনো ? সৌন্দর্য সম্বন্ধে কেহ শেষ কথা বলিতে পারে না। কোনো ফুলের সম্বন্ধে পৃথিবীর আদি কবি যাহা বলিয়াছেন তাহাতে তিনি তাহার সৌন্দর্যের শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তঁহার পরবর্তী কবি যদি আরও কিছু বলিয়া থাকেন তবে তাহা সেই ক্ষুদ্র ফুলের পক্ষে অধিক হয় না। বিষয়টা একই এবং পুরাতন কিন্তু আদিকাল হইতে এখনো পর্যন্ত মানুষ তাহার নূতনত্ব শেষ করিতে পারে নাই! আমি একটি তুচ্ছ ফুল সম্বন্ধে যতটা কথা বলিতে পারি, কোনো কবি তাহার অপেক্ষা ঢের বেশি বলিলেও যদি কথাটা অকৃত্ৰিম সুন্দরীরূপে প্রকাশ করা হয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমার মনে হইবে, বটে, বটে, ফুল সম্বন্ধে এতটা কথা বলা যাইতে পারে বটে! আমি যে এতদিন স্বীকার করি নাই, তাহাতে ফুলের খর্বতা নাই আমারই খর্বতা। ফুল আপনার মধ্যে অসীমতা প্রতিষ্ঠিত করিয়া সুন্দর হইয়া দাঁড়াইয়া আছে— যাহার যতটা ক্ষমতা সে ততটা অনুভব করে। অতএব এখানে বিষয় লইয়া কথা নহে, প্রকাশ লইয়া কথা। জুইফুল সুন্দর এ কথা বড়ো কবিও জানে ছোটো কবিও জানে, অকবিও জানে- কিন্তু যে যত,ভালো করিয়া প্ৰকাশ করে জুইফুলকে সে তত অধিক করিয়া আমার হাতে আনিয়া দেয়। কেবল তাঁহাই নয়। কারণ, যদি কেবল তাঁহাই হইত, তাহা হইলে জুইফুল সম্বন্ধে সবচেয়ে কুল্ল কবির কবিতা পড়িয়া তৎসম্বন্ধে আর কােনাে কবির রচনা পড়া অনাবশ্যক ও বিরক্তিজনক হহত। কিন্তু ফুলের মধ্যে অসীমতা আছে বলিয়াই শ্রেষ্ঠ কবির কবিতায় তাহার অগাধ গভীরতা এবং ভালো মন্দ সহস্ৰ কবির কবিতায় তাহার অপার বিস্তৃতি অনুভব করি। দেখিতে পাই, কালের অনেক পরিবর্তন হইয়াছে এবং মানবের মধ্যে অনেক বৈচিত্ৰ্য আছে কিন্তু তথাপি সর্বকালে সর্বকবির মধ্যে এই ফুলের সমাদর। এইজন্য এক কবির পরে আর-এক কবি যখন একই পুরাতন কথা বলে তখন ফুলের অসীমতার প্রতি আমরা আরও একটু নূতন করিয়া অগ্রসর হই।