পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য Nos বাংলা লেখক । লেখকদিগের মনে যতই অভিমান থাক, এ কথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে, আমাদের দেশে পাঠক-সংখ্যা অতি যৎসামান্য। এবং তাহার মধ্যে এমন পাঠক “কোটিকে গুটিক’ মেলে কি না। সন্দেহ, র্যাহারা কোনো প্ৰবন্ধ পড়িয়া, কোনো সুযুক্তি করিয়া আপন জীবনযাত্রার লেশমাত্র পরিবর্তন সাধন করেন। নিজীবি নিঃস্বত্ব লোকের পক্ষে সুবিধাই একমাত্র কর্ণধার, সে কর্ণের প্রতি পাঠকের এই আচল অসাড়তা লেখকের লেখার উপরও আপন প্রভাব বিস্তার করে। লেখকেরা কিছুমাত্র দায়িত্ব অনুভব করেন না। সত্য কথা বলা অপেক্ষা চতুর কথা বলিতে ভালোবাসেন। সুবিজ্ঞ গুরু, হিতৈষী বন্ধু, অথবা জিজ্ঞাসু শিষ্যের ন্যায় প্রসঙ্গের আলোচনা করেন। না, কূটবুদ্ধি উকিলের ন্যায় কেবল কথার কীেশাল এবং ভাবের ভেলকি খেলাইতে থাকেন। এখন দাঁড়াইয়াছে এই— যে যার আপনি আপনি সুবিধার সুখশয্যায় শয়ান, লেখকদিগের কাৰ্য, স্ব স্ব দলের বৈতালিক বৃত্তি করিয়া সুমিষ্ট স্তবগানে তঁহাদের নিদ্ৰাকর্ষণ করিয়া নেওয়া। মাঝে মাঝে দুই দলের লেখক রঙ্গভূমিতে নামিয়া লড়াই করিয়া থাকেন এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধের যত ििशा शून् । লেখকের পক্ষে ইহা অপেক্ষা হীনবৃত্তি আর কিছু হইতে পারে না। এই বিনা বেতনে চাটুকার এবং জাদুকরের কাজ করিয়া আমরা সমস্ত সাহিত্যের চরিত্র নষ্ট করিয়া দিই। মানুষ যেমন চরিত্রবলে অনেক দুরূহ কাজ করে, অনেক অসাধ্য সাধন করে, যাহাকে কোনো যুক্তি, কোনো শক্তির দ্বারা বশ করা যায় না। তাহাকেও চরিত্রের দ্বারা চালিত করে, এবং দীপস্তম্ভের নিনিমেষ শিখার ন্যায় সংসারের অনির্দিষ্ট পথের মধ্যে জ্যোতির্ময় ধ্রুব নির্দেশ প্রদর্শন করে-- সাহিত্যেরও সেইরূপ একটা চরিত্র আছে। সে চরিত্র, কৌশল নহে, তার্কিকতা নহে, & আমাদের দেশে পাঠক নাই, ভাবের প্রতি আন্তরিক আস্থা নাই, যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহাঁই চলিয়া যাইতেছে, কোনো কিছুতে কাহারও বাস্তবিক বেদনাবোধ নাই; এরূপ স্থলে লেখকদের অনেক কথাই অরণ্যে ক্ৰন্দন হইবে এবং অনেক সময়েই আদরের অপেক্ষা অপমান বেশি মিলিবে। এক হিসাবে অন্য দেশ অপেক্ষা আমাদের এ দেশে লেখকের কাজ চালানো অনেক সহজ। লেখার সহিত কোনো যথার্থ দায়িত্ব না থাকাতে কেহ কিছুতেই তেমন আপত্তি করে না। ভুল লিখিলে কেহ সংশোধন করে না, মিথ্যা লিখিলে কেহ প্রতিবাদ করে না, নিতান্ত ছেলেখেলা করিয়া গেলেও তাঁহা ‘প্রথম শ্রেণীর’ ছাপার কাগজে প্রকাশিত হয়। বন্ধুরা বন্ধুকে অস্নান মুখে উৎসাহিত করিয়া যায়, শত্রুরা রীতিমতো নিন্দা করিতে বসা অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে করে। সকলেই জানেন, বাঙালির নিকটে বাংলা লেখার, এমন-কি, লেখামাত্রেরই এমন কোনো কার্যকারিতা নাই, যেজন্য কোনােরূপু কষ্ট স্বীকার করা যায়। পাঠকেরা কেবল যতটুকু আমােদ । বোধ করে ততটুকু চোখ বুলাইয়া যায়ু, যতটুকু নিজের সংস্কারের সহিত মেলে ততটুকু গ্ৰহণ করে, বাকিটুকু চোখ চাহিয়া দেখেও না! সেইজন্য যে-সে লোক যেমন-তেমন লেখা লিখিলেও অন্যত্র, যে দেশের লোকে ভাবের কার্যকরী অস্তিত্ব স্বীকার করে, যাহারা কেবলমাত্র সংস্কার সুবিধা ও অভ্যাসের দ্বারাই বদ্ধ নহে, যাহারা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারাও কিয়ৎপরিমাণে স্বহস্তে জীবন গঠিত করে, সুন্দর কাব্যে, প্ৰবল বাগিতায়, সুসংলগ্ন যুক্তিতে যাহাদিগকে বাস্তবিকই