পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীত ও ভাব অল্পদিন হইল বঙ্গসমাজের নিদ্ৰা ভাডিয়াছে, এখন তাহার শরীরে একটা নব উদ্যামের সঞ্চার হইয়াছে। তাহার প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্মৃর্তি বিকাশ পাইতেছে। সেই স্মৃর্তি, সেই উদ্যম, সে । কাজে প্রয়োগ করিতে চায়- সে কাজ করিতে চায়। সে শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে চলিতে ফিরিতে চেষ্টা করিতেছে। একদল লোক মহা শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিয়াছেন, আরে, সর্বনাশ হইল! তুই উঠিস নে, তুই উঠিস নে! কে জানে কোথায় পড়িয়া যাইবি। তোর উঠিয়া কাজ নাই, তুই ঘুমা!” কিন্তু শিশুদেরও যে প্রকৃতি, নূতন সমাজেরও সেই প্রকৃতি। যখন তাহার ঘুম ভাঙিল, তখন সে নব উদ্যমে খেলা করিয়া ছুটিয়া বেড়াইতে চায়। পড়িবে না তো কী! প্রকৃতি যদি শিশুদের হৃদয়ে পড়বার ভয় দিতেন, তবে তাহারা ইহজন্মে চলিতে শিখিত । না। নব-উত্থান-শীল সমাজের হৃদয়েও পড়িবার ভয় নাই। যাহারা খুব ভালো করিয়া চলিতে শিখিয়াছে এমন-সকল বড়ো বড়ো বয়ঃপ্রাপ্ত সমাজেরাই পড়বার ভয় করুক, তাহাদের শক্ত হাড় দৈবাৎ একবার ভাঙিলে আর ঝাঁটু করিয়া জোড়া লাগিবে না। আমাদের শিশু সমাজ দশবার করিয়া পড়ুক তাহাতে বিশেষ হানি হইবে না; বরঞ্চ ভালো বৈ মন্দ হইবে না। তাই বলি, সমাজ একটা নুতন কাজে অগ্রসর হইবামাত্র আমনি দশজনে হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া না আসে যেন! আসিলেও বিশেষ কোনো ফল হইবে না। রক্ষণশীল মা বলিতেছেন, তাহার ছেলেটি চিরকাল র্তাহার স্তন্যপান করিয়া তাহার ঘরে থাকুক। উন্নতিপ্রিয় পিতা বলিতেছেন যে, তাহার ছেলেটির উপার্জন করিয়া খাইবার বয়স হইয়াছে, এখন তাহাকে ছাড়িয়া দাও, সে বাহির হইতে রোজগার করিয়া আনুক। ছেলেটিরও তাঁহাই ইচ্ছ। আর তাহাকে বাধা দেওয়া যায় না। এখন তাহাকে অস্বাস্থ্যকর মেহের জালে বদ্ধ করিয়া রাখা সুযুক্তিসংগত নহে। আমাদের বঙ্গসমাজে একটা আন্দােলন উপস্থিত হইয়াছে, এমন-কি, সে আন্দােলনের একএকটা তরঙ্গ যুরোপের উপকূলে গিয়া পৌঁছাইতেছে। এখন হাজার চেষ্টা করো-না, হাজার কোলাহল করো-না কেন, এ তরঙ্গ রোধ করে কাঁহার সাধ্য! এই নূতন আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে সংগীতের নব অভু্যুদয় হইয়াছে। সংগীত সবে জাগিয়া উঠিয়াছে মাত্র, কাজ ভালো করিয়া আরম্ভ হয় নাই। এখনো সংগীত লইয়া নানা প্রকার আলোচনা আরম্ভ হয় নাই, নানা নূতন মতামত উখিত হইয়া আমাদের দেশের সংগীতশাস্ত্রের বদ্ধ জলে একটা জীবন্ত তরঙ্গিত স্রোতের সৃষ্টি করে নাই। কিন্তু দিন দিন সংগীত-শিক্ষার যেরূপ বিস্তার হইতেছে, তাহাতে সংগীত-বিষয়ে একটা আন্দোলন হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে বোধ করি। এ বিষয় লইয়া একটা তর্ক-বিতর্ক দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব না হইলে ইহার তেমন একটা দ্রুত উন্নতি হইবে না। আমাদের সংস্কৃত ভাষা যেরূপ মৃত ভাষা, আমাদের সংগীতশাস্ত্ৰ সেইরূপ মৃত শাস্ত্র। ইহাদের প্ৰাণবিয়োগ হইয়াছে, কেবল দেহমাত্র অবশিষ্ট আছে। আমরা কেবল ইহাদের স্থির আচঞ্চল জীবনহীন মুখ মাত্ৰ দেখিতে পাই; বিবিধ বিচিত্র ভাবের লীলাময়, ছায়ালোকময়, পরিবর্তনশীল মুখশ্ৰী দেখিতে পাই না। আমরা কতকগুলি কথা শুনিতে পাই; অথচ তাহার স্বরের উচ্চনীচতা শুনিতে পাই না, কেবল সমস্বরে একটি কথার পর আর-একটি কথা কানে আসে মাত্র। হয়তো ক্ৰমে ক্রমে তাহার অর্থবোধ মাত্র হয়, কিন্তু তাহার অর্থগুলিকে সম্যকরূপে হজম করিয়া ফেলিয়া আমাদের হৃদয়ের রক্তের সহিত মিশাইয়া লইতে পারি না। আজ সংস্কৃত ভাষায় কেহ যদি কবিতা তৎক্ষণাৎ তাহারা ব্যাকরণ বাহির করেন, অলংকারের পুথিখানা খুলিয়া বসেন— যত্বণত্ব