পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

[ মন্দিরপথবর্তিনী ] “হ্মাত্ৰে” উপাধিকারী একটি মহারাষ্ট্রী ছাত্র ‘মন্দিরপথবর্তিনী” (To the Temple) নামক একটি রমণীমূর্তি রচনা করিয়াছিলেন। তাহারই সম্মুখের ও পার্থের দুইখানি ফোটােগ্রাফ ভারতীয় শিল্পকলার গুণজ্ঞাপ্রবার সারা জর্জ বার্ডবুডের নিকট প্রেরিত হইয়াছিল। প্রস্তাব ছিল এই ছাত্রটিকে যুরোপে শিক্ষাদানের সুযোগ করিয়া দিলে উপকার হইবার সম্ভাবনা। তদুত্তরে উক্ত ভারতবন্ধু ইংরাজমহােদয় এই মূর্তির প্রচুর প্রশংসা করিয়া পত্র লেখেন। তাহাতে প্ৰকাশ করেন, এই মূর্তিখানি গ্ৰীক ভাস্কর্যের চরমোন্নতিকালীন রচনার সহিত তুলনীয় হইতে পারে এবং বর্তমান যুরোপীয় শিল্পে ইহার উপমা মেলা দুষ্কর। তঁহার মতে যে শিল্পী যুরোপীয় কলাবিদ্যা না শিখিয়া নিজের প্রতিভা হইতে এমন একটি অপরাপ সৌন্দর্যের উদভাবন করিতে পারিয়াছেন তাহার ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ হইবার পূর্বে তাহাকে বিলাতে শিক্ষাদান না করাই শ্রেয়, কারণ যুরোপীয় শিল্পের অনুকরণে ভারতবর্ষের বিশেষ শ্ৰী, বিশেষ প্ৰাণটুকু অভিভূত হইয়া যাইতে পারে। এইখানে বলা আবশ্যক, বার্ডবুড় সাহেব দুইটি ভুল করিয়াছিলেন। প্রথমত, তিনি ফোটােগ্রাফ হইতে বুঝিতে পারেন নাই যে, মূর্তিটি প্রস্তরমূর্তি নহে, তাহা প্যারিস-প্লাস্টারের রচনা মাত্র। দ্বিতীয়ত, হ্মাত্রে বোম্বাই আর্টস্কুলে য়ুরোপীয় শিক্ষকের নিকট শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। এই দুই ভ্ৰম উপলক্ষ করিয়া চিজহলম নামধারী কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ‘পায়োনিয়র’ পত্রে বার্ডবুড় সাহেবের প্রতি কুটিল বিদ্রুপ বর্ষণ করিয়াছেন- এবং হ্মাত্রে-রচিত মূর্তির গুণাপনা কথঞ্চিৎ স্বীকার করিয়াও তাহাকে খর্ব করিতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। শিল্প সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ কেন, অনারব্ধ বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং এই তর্কের মধ্যে প্রবেশ করিতে ভারতবষীয় কাহারও অধিকার আছে কি না সন্দেহ। কিন্তু এই নবীন শিল্পীর অভু্যদয়ে আমাদের চিত্ত আশান্বিত হইয়া উঠিয়াছে। বার্ডবুড় সাহেব -কর্তৃক সম্পাদিত ‘ভারতশিল্প” পত্রিকায় পূর্বোক্ত দুটি ফোটােগ্রাফ বাহির হইয়াছে। তাহা বারংবার নিরীক্ষণ করিয়াও আমাদের পরিতৃপ্তি হয় না। রমণীর উত্তান বাম বাহুতে একটি থালা ও অধোলম্বিত দক্ষিণ হস্তে একটি পাত্র উরুদেশে সংলগ্ন। তাহার দক্ষিণজানু সুন্দর ভঙ্গিতে পশ্চাদবতী হইয়া সুকুমার পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে ধরণীতল স্পর্শ করিয়া আছে। তাহার দেবীতুল্য গঠনলাবণ্য নিবিড় নিবদ্ধ কাঞ্চলিকা ও কুটিলকুঞ্চিত অঙ্গবন্ত্র-দ্বারা আচ্ছন্ন না হইয়াও, অতিশয় মনোরম ভাবে সংবৃত। তরুণ মুখখানি আমাদের ভারতবর্ষেরই মুখ; সরল, নিগ্ধ, শান্ত এবং ঈষৎ সকরুণ। সবসুদ্ধ চিত্ৰখানি বিশুদ্ধ, সংযত এবং সম্পূর্ণ। এই চিত্রটি দেখিতে দেখিতে আমাদের বহুকালের বুভুক্ষিত আকাঙক্ষা প্রতিক্ষণে চরিতার্থতা লাভ করিতে থাকে। সহসা বুঝিতে পারি যে, আমরা ভারতবর্ষীয় নারীরূপের একটি আদর্শকে । মূর্তিমান দেখিবার জন্য এতদিন প্রতীক্ষা করিয়াছিলাম। সেই সৌন্দর্যকে আমরা লক্ষ্মীরূপে সরস্বতীরূপে অন্নপূর্ণরূপে অন্তরে অনুভব করিয়াছি, কিন্তু কোনো গুণীশিল্পী তাহাকে অমর দেহদান করিয়া আমাদের নেত্রসম্মুখে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেন নাই। " . দেশীয় স্ত্রীলোকের ছবি অনেক দেখা যায়। কিন্তু তাহা প্ৰাকৃত চিত্র। অর্থাৎ যাহারা প্রতিদিন ঘরে বাহিরে সঞ্চারণ করে, খায় পরে, আসে যায়, জন্মায় মরে তাহাদেরই প্রতিকৃতি। যে নারী আমাদের অন্তরে বাহিরে, আমাদের সাহিত্য সংগীতে নিত্যকাল জাগ্রত, বংশানুক্রমে চিরপ্রবহমান ভারতীয় নারীগণের মধ্যে স্থির হইয়া অমর হইয়া বিরাজ করিতেছেন, যিনি বৈদিককালে সরস্বতীতীরে তপোবনের গোষ্ঠগৃহে নবীন ছিলেন এবং যিনি অদ্য লীেহশঙ্খলিত গঙ্গাকূলে