পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯৮ রবীন্দ্ররচনাবলী নবরাজধানীর ড্রয়িং রুম সোফাপর্যাঙ্কেও তরুণী, সেই ভােবরদপিণী ভারত-নারী, যিনি সর্বকালে । ভারতব্যাপিনী হইয়াও আমাদের প্রত্যক্ষগোচর নহেন- তাঁহাকে প্ৰত্যক্ষগম্য করা আমাদের চিত্তের কামনা, আমাদের শিল্পের সাধনা। যে শিল্পী কল্পনামস্ত্ৰে সেই দেহের অতীতকে মূর্তির দ্বারা ধরিতে পারেন, তিনি ধন্য। হ্মাত্রে-রচিত মূর্তির ছবিখানি দেখিলে মনে হয়, যে শুদ্ধাশুচি ভক্তিমতী হিন্দুনারী চিরদিন মন্দিরের পথে গিয়াছে এবং চিরদিন মন্দিরের পথে যাইবে, এ সেই নামহীন জন্মহীন মৃত্যুহীন রমণী- ইহার সম্মুখে কোন এক অদৃশ্য নিত্য তীর্থদেবালয়, ইহার পশ্চাতে কোন এক অদৃশ্য নিত্য গৃহপ্ৰাঙ্গণ। - এই ছবির মধ্যে গ্ৰীসীয় শিল্পকলার একটা ছায়া যে পড়ে, নাই, তাহা নহে। কিন্তু দেশীয় শিল্পীর প্রতিভাকে তাহা লঙ্ঘন করে নাই। বরঞ্চ তাহার সম্পূর্ণ অনুবতী হইয়া রহিয়াছে। ইহাকে ঠিক অনুকরণ বলে না। ইহাকে বরঞ্চ স্বীয়করণ নাম দেওয়া যায়। এইরূপ পরেরকে নিজের, বিদেশেরকে স্বদেশের, পুরাতনকে নূতন করিয়া লওয়াই প্রতিভার লক্ষণ। ইংরাজি আর্টস্কুলে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া এই ছাত্রটির শিল্পবোধ উদবোধিত হইয়াছে তাহাতে আমাদের বিস্ময়ের বা ক্ষোভের কোনো কথা নাই। এবং তাহা হইতে এ কথাও মনে করা অকারণ যে, তবে তাহার রচনা মূলত যুরোপীয়। ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসে যাহাকে বলে শেকসপিরীয় যুগ। তাহা তৎকালীন ইতালীয় ভাবআন্দোলনের সংঘাত হইতে উদ্ভূত। তখন দেশী বিদেশীর সংস্রবে। ইংরাজি সাহিত্যে খুব একটা আবর্ত জন্মিয়াছিল— তাহার মধ্যে অসংগত, অপরিণত, অপরিমিত, অনাসৃষ্টি অনেক জিনিস । ছিল- তাহা শোভন সুসম্পূর্ণ এবং স্বাভাবিক হইয়া উঠিতে অল্প সময় লয় নাই। কিন্তু সেই আঘাতে ইংলন্ডের মন জাগিয়া উঠিয়াছিল এবং সাহিত্যকলার অনেকগুলি বাহ্য আকার প্রকার, ছন্দ এবং অলংকার ইংরাজ আত্মসাৎ করিতে পারিয়াছিল। তাহাতে ইংরাজি সাহিত্যের ক্ষতি হয়। নাই, বৃদ্ধি হইয়াছে। আমাদের মনকেও সুগভীর নিশ্চেষ্টতা হইতে প্ৰবুদ্ধ করিয়া তুলিবার জন্য একটি নূতন এবং : প্ৰবল ভাবপ্রবাহের সংঘাত আবশ্যক হইয়াছিল। পশ্চিমের বেগবান ও প্ৰাণবান সাহিত্য ও শিল্পকলা সেই আঘাত করিতেছে। আপাতত তাহার সকল ফল শুভ এবং শোভন হইতে পারে না। এবং প্রথমে বাহ্য অনুকরণই স্বভাবত প্রবল হইয়া উঠে- কিন্তু ক্ৰমে ক্ৰমে ধীরে ধীরে । ভারতবর্ষের লক্ষ্মী তাহার মধ্যে প্রবেশ করিবে, অসংগতির মধ্যে সংগতি আনিবে- এবং সেই বিদেশী বন্যায় আনীত পলিমাটির ভিতর দিয়া দ্বিগুণ তেজে আপনারই শস্যগুলিকে অঙ্কুরিত, পুষ্পগুলিকে বিকশিত, ফলগুলিকে পরিণত করিয়া তুলিবে। g ইহা না হইয়া যায় না। আমাদের চতুর্দিকের বিপুল ভারতবর্ষ, আমাদের বহুকালের সুদূর ধরণীর মতো তাহা গ্ৰহণ করে- কতকটা সফল হয়, কতকটা বিফল হয়, কতকটা কুফলও হয়, কিন্তু সমস্ত ফলাফলের মধ্যে ভারতবর্ষ থাকিয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে আমরা ইংরাজি হইতে অনেক বাহ্য আকার প্রকার লাভ করিয়াছি। তাহার মধ্যে যেগুলি, অন্তরের ভাবপরিস্ফুটনের জন্য সর্বজনীন ও সর্বকালীন রূপে সর্বাপেক্ষা উপযোগী তাহাঁই থাকিয়া যাইবে। উপন্যাস লিখিবার ধারা আমরা ইংরাজি সাহিত্য হইতে পাইয়াছি, কিন্তু প্রতিভাশালী লোকের হস্তে সে উপন্যাস সম্পূর্ণ বাংলা উপন্যাস হইয়াছে। সূর্যমুখী বাঙালি, ভ্রমর বাঙালি, কপালকুণ্ডলা ঘরের সংস্রব ছাড়িয়া, মনের মধ্যে পালিত হইয়াও কোনো ছদ্মবেশধারিণী ইংরাজি রোমালের নায়িকা নহে, সে বাঙালি বনবালিকা। -- আসল কথা, প্রতিভা বৃহৎ বনস্পতির ন্যায়। নূতন-চাব-করা আধহাত গভীর জমির মধ্যে